বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১২

এ দেশের মানুষ ভারত-মুখাপেী হবে না



সাদেক খান
তারিখ: ২২ নভেম্বর, ২০১২

বিগত সপ্তাহান্তে বাংলা একাডেমীর নতুন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি নতুন বইয়ের হাইপ্রোফাইল বা মর্যাদাবান প্রকাশনা উৎসব। বইটির লেখক ভারতীয়, প্রকাশক এ দেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইংরেজি ডেইলি স্টার। প্রকাশকের জ্ঞাতিকুটুম্ব (প্রতিষ্ঠানের মালিকানার বড় শরিকের সূত্রে) বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলোয় পরদিন (১৭ নভেম্বর) শেষ পাতায় আকর্ষণীয়ভাবে আয়তরেখাবন্দী করে ওই অনুষ্ঠানের একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার চমকপ্রদ শিরোনাম, উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে, ‘দেশ ভাগ একটি ভুল’।
ওই দিনই সন্ধ্যায় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের বৈঠকখানায় টকশোতে অংশ নেয়ার জন্য অপেমাণ কিছু বিজ্ঞ নাগরিকের একজনের নজরে পড়ল ওই শিরোনাম। একরকম চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘এই যে, আবার শুরু হয়েছে। যারা বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র সাব্যস্ত করার প্রচার শুরু করেছিল, এরা এখন অন্য কায়দায় বাংলাদেশের ভারতভক্তির পাঁয়তারা শুরু করেছে।’ তার এমন ধারণা শুধরাতে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘ভুল করছেন, এটা প্রথম আলোর উদ্যোগ নয়, প্রথম আলো রিপোর্ট করেছে মাত্র। আর শিরোনামটি উদ্ধৃতি। ভারত বিভাগের সময় পাকিস্তানের ঘরবাড়ি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতযাত্রার বেদনাদায়ক স্মৃতি থেকে এ কথা লিখেছেন ভারতের প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কূটনীতিবিদ কুলদীপ নায়ার।’ দ্বিতীয় বক্তা পত্রিকা থেকে পড়ে শোনালেন : কুলদীপ নায়ার বলেছেন, ‘হিন্দু, মুসলিম, ভারতীয়, পাকিস্তানিÑ এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এখন আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ঐক্যবদ্ধ একটি দণি এশিয়া গড়তে হবে। দেশ বিভাগের পর আমি পাকিস্তান ছাড়ি, আমার পরিবারের সাথে বিদায়ের সময় কান্নার যে মুহূর্ত এমন অনেক কিছুই আমি পারিনি তুলে ধরতে। দেশ বিভাগের পর লাখ লাখ উদ্বাস্তু মানুষ যখন দেশ ছাড়ছিল, তখন হেলিকপ্টার থেকে তা দেখে জিন্নাহ কপাল চাপড়ে বলেছিলেন, এ তিনি কী করলেন! আমার অনুভূতি হলো, দেশ বিভাগ ভুল ছিল। দেশ বিভাগের প্রেতি না হলে এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হতো না।’
এবার একজন তৃতীয় বক্তা টিপ্পনি কাটলেন, ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি তো দেশ বিভাগের পরে নয়, অখণ্ড ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার আমলে। ১৮১৭ সালের হিন্দু কলেজে তার গোড়াপত্তন, তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানসম্মত রূপ দিয়েছিলেন বীর সাভারকর। মুসলিম লীগ সে পথে এগিয়েছে আরো পরে ১৯৪৩ সালে। ভারত বিভাগের পর খোদ ভারতেই এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প বর্ণাশ্রমের ভেদবুদ্ধি বেশি করে ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত নেই বললেই চলে। তাহলে আমরা কেন সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হওয়ার বাহানায় অন্য নামে শিথিলভাবে হলেও অখণ্ড ভারতভুক্ত হতে যাবো?’ চতুর্থ বক্তা বললেন, ‘কপাল চাপড়ে জিন্নাহ সাহেব কখনো বিলাপ করেছেন, এটা তার সাহেবি মেজাজ চালচলনের সাথে মেলে না; কোনো ঐতিহাসিক বা জীবনী লেখক এমন কথা কোথাও লেখেননি। তা ছাড়া ধর্মভিত্তিক বাসিন্দা বদল বা পপুলেশন ট্রান্সফারের কথা তো জিন্নাহ বলেননি, বলেছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস নেতারা।’ একজন পঞ্চম বক্তা প্রশ্ন তুললেন, ‘পাকিস্তান ছেড়ে আসার মনোবেদনা থেকেই যদি বইটি লেখার হুপ জন্মে থাকে, তাহলে তো এর প্রকাশ হওয়া উচিত পাকিস্তানে; বাংলাদেশে কেন?’ সে সম্পর্কে প্রকাশক পরিবারের ব্যাখ্যা পেশ করতে দ্বিতীয় বক্তা আবার মুখ খুললেন। পত্রিকা থেকে পড়লেন, প্রথম আলো সম্পাদক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, দুই নেত্রী, রাজনীতি এসব নিয়েও তিনি বিস্তারিত লিখেছেন বইটিতে। তিনি মনে করেন, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা আছে। তিনি সেই কারণ খুঁজে ফিরছেন।’
তৃতীয় বক্তা টিপ্পনি কাটলেন, এই প্রকাশনা উৎসবের ধুমধাড়াক্কার পেছনেও নিশ্চয় ‘অন্য কোনো ঘটনা আছে!’ দ্বিতীয় বক্তা পড়ে চললেন : ‘ড. কামাল হোসেন বলেন, একটি অসাধারণ বই; কুলদীপ নায়ারের যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করতে হয় তা হলো, দণি এশিয়ার মানুষের প্রতি তার যে ভালোবাসা, তার যে প্রতিশ্র“তি, এর কোনো তুলনা হয় না। (প্রকাশক প্রতিষ্ঠান প্রধান ডেইলি স্টার সম্পাদক) মাহফুজ আনাম বলেন, ২০ বছর আগে কুলদীপ নায়ার পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন; ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদারের কাজও করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দণি এশিয়ার দেশগুলো এক হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী হতে পারে।’
চতুর্থ বক্তা এবার বললেন : “দণি এশিয়াজুড়ে নিবিড় রাষ্ট্রপুঞ্জ গড়ার স্বপ্ন বা বিশ্বাস যদি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ঔপনিবেশিক স্মৃতিমুগ্ধ কোনো ব্যক্তি পঁয়ষট্টি বছর ধরে পুষে থাকেন, বাদ সেধে তার মোহভঙ্গ করব না। কিন্তু বাস্তবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টান্তের কথা বলা হলো, তার শক্তি কোথায়? ইউরো জোনে শামিল হয়ে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, গ্রিস এসব ভূমধ্যসাগরীয় দেশ এখন ফতুর হতে বসেছে। ইউরোপজুড়ে চলছে সুবিধাবঞ্চিত নাগরিক বিােভ। লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস, ব্রাসেলসের মতাধর সুবিধাভোগী ইউরোপীয় নেতারা মার্কিন শক্তির বদৌলতে ন্যাটো জোটের গোপন ও প্রকাশ্য সমরকৌশল প্রয়োগে মত্ত ভূমধ্যসাগরীয় আরব দেশ লিবিয়া ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ-অশান্তি পাকিয়ে তুলে ফায়দা লোটার নয়া ঔপনিবেশিক কারসাজি ফেঁদেছে এরা। তাতে এখন আর ইউরোপজুড়ে অস্থিরতা থেকে নাগরিক দৃষ্টি ফিরছে না। এ দিকে ভারতজুড়ে চলছে নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের পীড়া, বঞ্চিত বা অবদলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ। রিজার্ভ পুলিশ, দমন আইনের সাত খুন মাফ বিশেষ মতা আর সৈন্যবল দিয়ে সেই প্রতিরোধ ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে। স্বাধীন নাগা, স্বাধীন অহম, স্বাধীন কামতাপুরী, স্বাধীন ত্রিপুরী বৈরিতার উত্তর-পূর্ব ভারতীয় চোরাবালি আর গেরিলা নকশাল উপদ্রুত মধ্যভারতীয় ফল্টলাইন বা বিচ্যুতি রেখা নেপালের পাদদেশ থেকে দণি ভারতের অন্ধ্ররাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই ঝুঁকির বেড়ি পেরিয়ে আমরা কেন দিল্লির দিকে তাকাতে যাবো? বাংলাদেশের কৃষক প্রতিরোধ ১২৫ বছর ধরে ইংরেজের সিপাই আর জমিদারের পাইক-বরকন্দাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাতন্ত্র্য আর আত্মমর্যাদাবোধ বজায় রেখেছে। সেই স্বাতন্ত্র্য ভিক্টোরিয়ার আমলে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সিপাহি বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রজন্ম দুই বিশ্বযুদ্ধের যুগসন্ধিতে ইংরেজি স্কুলে পড়ে ইংরেজি কায়দা-কানুন রপ্ত করে ইংরেজের ভারতবিভক্তিকালে ভোটযুদ্ধে পাকিস্তানের প নিয়েছে, অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। নিজেদের মতো করেই আমরা বাঁচছি, স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতাম অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করেছি, প্রবৃদ্ধির মুখ দেখতে শুরু করেছি। আমরা কেন ফের দিল্লির আঁচল ধরতে যাবো? আমাদের ুদ্র পরিসরই ভালো, স্মল ইজ বিউটিফুল। জনসম্পদে আমরা খাটো নই, জনসংহতিও ‘দশটা লতা পাকিয়ে’ নিরেট। ভূরাজনৈতিক পাকচক্রে মতার খেলায় উদভ্রান্ত নেতানেত্রীরা দিল্লির দরবারে যখন তখন দৌড়াতে পারেন। কিন্তু এ দেশের মানুষ মোটেও দিল্লির মুখাপেী হবে না।”
এবার প্রথম বক্তা আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন : ‘খালেদা জিয়াই গোলমাল বাধিয়েছেন। এত দিন দেশের রাজনীতিতে একটা ব্যালেন্স ছিল। দিল্লির দালালরা সরাসরি দিল্লিকে মেনে চলার কথা বলতে সাহস পেত না। এখন শেখ হাসিনা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দেখাদেখি সুড়সুড় করে খালেদাও দিল্লিতে ভিজিট দিয়ে এসেছেন। তাই দিল্লির দালালরা এখন নির্ভয়ে অখণ্ড ভারতের নতুন গান গাইছে।’
শেষোক্ত মন্তব্যের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাক কিংবা না-ই থাক, এ কথা বহুলালোচিত যে, খালেদার সাম্প্রতিক দিল্লি সফর একটা ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে। তাই তার প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে আবেগবর্জিত বিতর্ক-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেটা এখনো চলছে সুধী সমাজে। সেই সাধারণ বিতর্কের জের ধরে প্রথমে দেখা দরকার খালেদা জিয়ার এই মুহূর্তে দিল্লি সফরের ভূরাজনৈতিক কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল কি না বা কী ছিল।
এ সম্পর্কে ৭ নভেম্বর তার ‘সময়চিত্র’ কলামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল লিখেছেন : “(এ দেশে) বিএনপির (বিগত) আমলে জঙ্গিবাদী রাজনীতির প্রসার ঘটে। (ওই আমলেই তা দমনেও কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। তবে) বিএনপির শেষ আমলে ভারতীয় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল। প্রথম কারণে বিএনপির প্রতি রুষ্ট ছিল আমেরিকা, ইউরোপ আর ভারত। দ্বিতীয় কারণে প্রধানত ভারত। গত আমলে বিএনপির সরকার কোনো এক বিচিত্র কারণে তাইওয়ানের একটি বাণিজ্যিক অফিস খোলার অনুমতি দিলে বিএনপির ‘ন্যাচারাল এলাই’ চীনও রুষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিল কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে যাদের প্রভাব ক্রমেই ীয়মাণ। বিএনপি তাই এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য। ভবিষ্যতে মতায় যেতে হলে শুধু জনসমর্থন যথেষ্ট নয়, এদের সহায়তাও লাগবে, এটা বিএনপির উপলব্ধিতে না করার কথা নয়।
শক্তিশালী প্রতিবেশী ও মুরব্বিদের উপো করে এই যুগে মতায় থাকার বা মতায় আসার নজির কম। ইরানে আহমাদিনেজাদ আর উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুংয়ের পরিবার তা পারছেন শক্ত জাতীয় ঐক্য, আদর্শবাদ আর মোটামুটি স্বনির্ভর অর্থনীতির কারণে। ভেনিজুয়েলায় হুগো শ্যাভেজ পারছেন গোটা ল্যাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং তেলনির্ভর অর্থনীতির শক্তির কারণে। কিউবা টিকে আছে মূলত ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্ব আর কিউবাবাসীর কৃচ্ছ্রমূলক আত্মত্যাগের কারণে। এই দেশগুলোর ওপরও খবরদারির চেষ্টা চলছে নিরাপত্তার নানা অজুহাতে। পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণে উত্তর কোরিয়া তা উপো করে চললেও অন্যদের পে সেটি আরো বহু বছর পর্যন্ত হয়তো সম্ভব হবে না।
আগে একটা সময় ছিল, যখন আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিকÑ জ্বালানি, অস্ত্র, অবকাঠামোভিত্তিক ব্যবসায় আর আন্তর্জাতিক পুঁজির আধিপত্য বিস্তার। সোভিয়েত যুগে রাজনৈতিক আদর্শের আধিপত্যের লড়াইও জোরদার ছিল। এখন নাইন-ইলেভেনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ইস্যু। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা, এই তত্ত্ব দুর্বল দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক খবরদারির একধরনের নৈতিক যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় প্রদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক খবরদারির সুযোগকে আরো প্রসারিত করেছে এবং একই সাথে বিএনপিকে মিত্র হিসেবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এই পরিপ্রেেিত খালেদা জিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপিকে উদার না হোক, অন্তত মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে (ভূরাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে) বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।”
এবার দেখা যাক, খালেদার এই ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ অর্জনের প্রয়াস কতটা সফল হয়েছে। সে সম্পর্কে একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে ১৪ নভেম্বর আমার দেশ সম্পাদক (সাবেক খালেদা জিয়া সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা) মাহমুদুর রহমান লিখেছেন, “মহাজোট সরকারের প্রথম আড়াই বছরে ভারত থেকে যেসব কর্তাব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন, তাদের মধ্যে কেউই বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করার জন্য সময় বের করতে পারেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশী-বিদেশী কৌশল প্রয়োগে বিএনপিকে রীতিমতো ধরাশায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা নির্বাচনে বিএনপির অবিশ্বাস্য পরাজয়ের পরিণতিতে দলটিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক ভাবতেও শুরু করেছিলেন। ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়ন করতে না পারলেও ‘মাইনাস ওয়ান’ করতে পারা গেছে কল্পনা করে তাদের আহাদের সীমা ছিল না। চেয়ারপারসনের সাম্প্রতিক ভারত সফর দলটিকে তাই নিশ্চিতভাবেই নতুন করে মতার পাদপ্রদীপে নিয়ে এসেছে। উজ্জীবিত দলীয় নেতাকর্মীরাও আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে মতায় ফেরার স্বপ্ন দেখছেন। আগেই উল্লেখ করেছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ অনেক দিন ধরেই বিএনপিকে আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদ দিয়ে আসছিল। এই সফরের মাধ্যমে তাদের সেই চাওয়াও অনেকটাই পূরণ হয়েছে। সুতরাং মতায় থাকতে চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্ধুহীন হয়ে পড়ার যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, তারও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। কাকতালীয়ভাবে বিগত চার বছরে বর্তমান মতাসীনরাই বরং বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।”
বাংলাদেশের সুশীলসমাজের যে অংশ তৃতীয় শক্তি উত্থানের মাধ্যমে নবরূপে ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নের আশায় কিছু দিন যাবৎ নড়েচড়ে উঠছিল, তারাও দিল্লিতে খালেদা জিয়ার উষ্ণ আতিথেয়তাপ্রাপ্তিতে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছেন। সফরের উষ্ণতা প্রমাণ করেছে, ভারত আপাতত অচেনা কোনো তৃতীয় শক্তিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সাউথ ব্লক এবং ‘র’-এর নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জেনারেল মইনের মতো দাসসুলভ চরিত্র খোঁজার চেয়ে বিএনপিতে গওহর-মসিউর মার্কা চক্রকে উৎসাহিত করতেই অধিকতর আগ্রহী। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেেিত সেনাবাহিনীতে মইন-মাসুদ গং খুঁজে পাওয়া এবার অন্তত সহজ না-ও হতে পারে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো এক সফরেই বেগম খালেদা জিয়া ২০২১ পর্যন্ত মতায় থাকতে আগ্রহী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বিগ্ন করার পাশাপাশি বায়বীয় তৃতীয় শক্তিকেও হতোদ্যম করতে পেরেছেন।
অন্য দিকে, দেশের অভ্যন্তরে মিডিয়ার আনুকূল্য লাভের েেত্রও বেগম জিয়ার ভারত সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়ার বেশির ভাগ দীর্ঘ দিন ধরে ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল। বিভিন্ন দ্বিপীয় ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরণে বিএনপির দৃঢ় অবস্থানে এরা এত দিন তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীলতার গন্ধ খুঁজে পেত। বাংলাদেশের বুক চিড়ে ভারতকে ট্রানজিট প্রদান আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে বিপজ্জনক এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হলেও কয়েকটি ভারতপন্থী পত্রিকা সর্বদা ট্রানজিটের পইে ওকালতি করেছে। ট্রানজিট প্রশ্নে বিএনপির দৃশ্যত নমনীয় অবস্থান আগামী নির্বাচনে ওই সব পত্রিকার সমর্থন লাভে দলটির জন্য সহায়ক হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারক গোষ্ঠী আন্দোলন ছাড়া কিংবা যৎসামান্য আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী। ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার বিনিময়ে তাদের দাবির প্রতি দেশের সুশীলসমাজ এবং ভারতপন্থী মিডিয়ার সমর্থন লাভ করা গেলে দলীয় বিবেচনায় লাভের পাল্লাই ভারী হবে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আপসহীন শেখ হাসিনাকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে হলে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ অপরিহার্য। সেদিক থেকেও ভারত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।”
শেখ হাসিনাকে ‘আপসহীন নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে’ ভারত আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে চাইবে কি না, সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। প্রথমে দেখা যাক একান্তে প্রদত্ত ভূরাজনৈতিক চাপ বা টোপ যা-ই বলা যাক, তাতে সাড়া দিয়ে মানুষের ধারণা বা পাবলিক পারসেপশনে খালেদা কী ব্যতিক্রম ঘটালেন। এ সম্পর্কে ১০ নভেম্বর কবি-প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন ‘এবার বিএনপির আওয়ামীকরণ!’ শিরোনামে ভাষ্যদান করেছেন তার ‘যুক্তি তর্ক গল্প’ কলামে। তার আশ্চর্যবোধক চিহ্নটির ব্যাখ্যা অনুসরণ না করে আমরা শুধু তার ইন্ট্রো বা মুখবন্ধটি উদ্ধৃত করব। তিনি লিখেছেন, “বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ভারত বিজয় হলো, নাকি ভারত জয় করল বিএনপির মন, সেটাই এখন জল্পনার বিষয়। তবে এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আভাস মিলছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেতার সাথে ভারতের সরকারপ্রধানসহ রাষ্ট্রপতি ও বিরোধী রাজনীতিবিদদের যেসব বৈঠক হয়েছে, তাতে মূলত ছিল ভারতের দিক থেকে বিএনপির কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে সুস্পষ্ট বক্তব্য। মূল তিনটি বিষয়ের মধ্যে দু’টি বিষয় সরাসরি ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, যেমনÑ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেয়া এবং ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদান। তৃতীয়টি দৃশ্যত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তবে এর সাথে ছিল জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক, জঙ্গি-ইসলামি দলগুলোর প্রতি বিএনপির মনোভাব ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিষয়। তাতে বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপে গণতান্ত্রিক শক্তি মতায় থাকার বিষয়ে ভারতের আগ্রহ স্পষ্ট হয়। আমাদের আপসহীন নেত্রী মৌখিকভাবে এসব বিষয়ে সম্মত হয়েছেন বলে শোনা যায়। অতীতকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকানোর কথা তার মুখে শোনা গেছে। ভারতীয় নেতাদের মুখেও ছিল একই ধরনের সুর।”
এখন ভারতীয় মিডিয়া আর দিল্লির ওয়াকিবহাল মহল সূত্রে পাওয়া খবর থেকে পরখ করা যাক, ভারতীয় নেতারা কী চেয়েছেন এবং ‘আপসহীন’ খালেদা কী বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। ভারতের চাওয়া নিয়ে ২৮ অক্টোবর টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার বিশ্লেষণে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়েছে (সংিেপত) : আগামী বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ওই নির্বাচনে জিতে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির মতায় আসার বেশ সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে।
নয়াদিল্লির নিজস্ব স্বার্থ বা পছন্দ-অপছন্দ (যাই থাক না কেন), ঢাকার মতায় কে থাকবে, তা তারা ঠিক করে দিতে পারে না। গত চার বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও আরো উন্নতির সুযোগ আছে। আগামী নির্বাচনে যদি বিএনপি মতায় আসে, তার পরও এই অগ্রগতি বজায় রাখতে চাইবে নয়াদিল্লি। (যেসব বিষয়ে) খালেদা জিয়ার কাছ থেকে পরিষ্কার হতে চাইবে ভারত, তার মধ্যে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্দলীয় নিরপে সরকারের অধীনে নির্বাচনের এই ব্যবস্থা গত বছর বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি চাইছে, ওই ব্যবস্থা আবার চালু করা হোক, তা না হলে নির্বাচন বর্জনের হুমকিও তারা দিয়ে রেখেছে। যদিও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলটি সুখকর ছিল না। সেনাসমর্থিত ওই সরকারের সময় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। এ বিষয়ে বিএনপি কী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তা জানতে চাইবে ভারত। দাবি পূরণ না হলে নির্বাচন বর্জনের বিষয়ে তারা কি সত্যিই অনড় থাকবে? আরেক দফায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের কোনো পরে জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। (দ্বিতীয়) যুদ্ধাপরাধের বিচার। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেতা নির্ভর করছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সফল সমাপ্তির ওপর। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই অপরাধের জন্য যারা অভিযুক্ত হয়েছেন এবং যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, তারা বিএনপি এবং তাদের মিত্র দল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ও বর্তমান নেতা। কাজেই বিএনপি মতায় এলে তাদের আমলে বিচার হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। তাই এ েেত্রও খালেদা জিয়ার অবস্থান কী এবং তিনি মতায় গেলে বিচার অব্যাহত রাখবেন কি না, তা জানতে চাইবে ভারত।’
দিল্লিতেই বিএনপি নেতাদের সূত্রে প্রকাশ, ভারতের ওই প্রশ্নগুলোর জবাবে বিএনপি দলনেত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।
অন্য দিকে জামায়াত ও ইসলামপন্থীরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট আছে বলেই তারা ‘ধর্মনিরপে’ভাবে দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত হয়েছে। যেমন বিগত বিএনপি শাসনামলে দুই জামায়াতমন্ত্রী দুর্গাপূজার মণ্ডপে গিয়ে মূর্তিপূজারিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে এসেছেন। ইসলামপন্থীদের সাথে না রাখলে তারা জঙ্গিবাদের খপ্পরে পড়বে। তবে ট্রানজিট, ভারতীয় স্বার্থবিরোধীদের বাংলাদেশে জায়গা না দেয়া ইত্যাদি প্রশ্নে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ-ভারত বোঝাপড়ায় হাল আমলে যে ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হয়েছে, অকপটে সেটা বজায় রাখার কথা দিয়ে এসেছেন খালেদা।
ভারত সন্তুষ্ট হয়েছে কি? বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় যে মন্তব্য প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে ভারতের সন্তুষ্টি নয়, সন্দেহবাতিকের অভিব্যক্তি সুস্পষ্ট। তিনি লিখেছেন, ‘বিএনপির নেতাদের ভারতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন দেখা গেছে, যা আগে থেকে ইতিবাচকভাবেই আলাদা। এ পরিবর্তন নিয়ে অনেকে এখনো সন্দিহান। সত্যি সত্যিই উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্ক বদলাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে অনেকেই অনিশ্চিত।
বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, ভারতের সাথে সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং খালেদা জিয়া সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থই জোরের সাথে তুলে ধরেছেন। তিনি খোলাসা করে বলেছেন যে, খালেদা জিয়া ট্রানজিট নয় বরং বাদবাকি এশিয়ার সাথে সংযুক্ত হওয়ার বিষয়েই একমত হয়েছেন।
(এ ছাড়া) বিশ্বাসযোগ্যতার স্বার্থে হয়তো খালেদা জিয়াকে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যুতে জামায়াতের থেকে আলাদা হতে হবে। এ ব্যাপারে শক্তিশালী জনমত থাকলেও বিএনপি সরাসরি বিচারের বিরোধিতা না করলেও এখনো স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। বাইরের সাথে সম্পর্ক যার মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কও পড়ে, তা আসলে শেষ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিধারার পাদটীকা।
খালেদা জিয়ার ঢাকা ফেরার তিন দিন পর সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মুখপাত্রকে যে বলতে হয়েছে, দলের ভারতনীতির পরিবর্তন হয়নি, তাতে ভারত ুণœ হয়েছে দেব মুখার্জি তেমনই ইঙ্গিত করেছেন। এ ছাড়া খালেদা জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর শেখ হাসিনার পুলিশি অ্যাকশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। জামায়াতকর্মীরা পুলিশকে রুখে দাঁড়াচ্ছে, পুলিশেরও দ্বিধা দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের গণমিছিলে ছিল জামায়াতকর্মীদের প্রবল উপস্থিতি। দেব মুখার্জির মন্তব্যে খোলাখুলিই বলা হয়েছে, বিএনপিকে ‘জামায়াত থেকে আলাদা হতে হবে।’ এ দেশের ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিধারা’ সেটা হতে দিচ্ছে না। ভারত সেদিক থেকে জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ধারা থেকে হটাতে না পেরে অবশ্যই নিরাশ হয়েছে।
তাহলেও ভারতীয় আধিপত্যবাদী কূটনীতিরই জয় হয়েছে। মূল ধারার তিন নেতানেত্রী যারা প্রত্যেকে এক দশক বা তার কিছু কমবেশি সময় ধরে বাংলাদেশ শাসন করেছেন, তারা সবাই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের আগে শলাপরামর্শের জন্য দিল্লির দরবারের মুখাপেী হয়েছেন। বাংলাদেশের ন্যায্য সার্বজনীন চাহিদাগুলো মেটাতে কোনো সাফ কথা কারো কাছে বলেনি ভারত। তাই আঠারোদলীয় বিরোধী জোটনেত্রী দিল্লি দরবারে হাজিরা দিয়ে যদি সব প্রশ্নে দিল্লির কাছে ‘নতজানু’ না-ও হয়ে থাকেন, দরকষাকষি ছাড়াই একতরফা যেটুকু ‘সম্মতি’ দিয়ে এসেছেন, সেটা ভারতের অর্থনৈতিক ও রণকৌশলগত সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকারের নমুনা হিসেবেই গণ্য হবে।
লেখক : বি্িযশষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাগ্য নিয়ে তামাশা

সাদেক খান


সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষ মাস তথা এই ইংরেজি সালের জুন মাসটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের। হাল আমলে নিত্যনৈমিত্তিক খুন, লাশ উদ্ধার আর গুমের খবরের মধ্যে জুন মাসের একুন ছিল ৪০৭ খুন, গুপ্তহত্যা বা গুমের লাশ ১২, ক্রসফায়ার বা র্যাব-পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ৫। দেরি করে পাওয়া খবরে ৩০ জুন খুন হওয়া ৯ লাশ উদ্ধার ওই হিসাবে আসেনি। ওই ৯ জনের মধ্যে ছিল ঢাকার নবাবগঞ্জে বিল থেকে উঠানো সাত বছরের মেয়ের লাশ, ফরিদপুরের সালথায় পাটক্ষেতে ফেলে যাওয়া নয় বছরের ছেলের লাশ, বড়াইগ্রাম আর ধামরাইয়ে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অজ্ঞাত তরুণ-তরুণীর লাশ, চরফ্যাশনে সাগরে চুবিয়ে মারা জেলের লাশ, কুয়াকাটায় ছেলের হাতে খুন হওয়া বাবার লাশ, বালিয়াডাঙ্গা আর মিঠাপুকুরে যথাক্রমে যৌতুকের জন্য নির্যাতনে আর পরকীয়ার সন্দেহে দুই গৃহবধূ খুন আর ধামরাইয়ে জুয়ার টাকার ভাগ নিয়ে খুন হওয়া স্কুলছাত্রের লাশ। এভাবে প্রতিদিন গড়ে খুন হয়েছে ১৪ জনের বেশি। হিসাবে আরও ধরা হয়নি বেশকিছু লঞ্চ ও নৌকাডুবির মৃত্যু, অপঘাত মৃত্যুর সংখ্যাও ধরা হয়নি। যেমন ৩০ জুনেরই শুধু খবর : সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত চার, আহত দশ, বন্যার পানিতে ডুবে মরেছে দুজন, সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে মৃত পাঁচ, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরেছে একজন, ট্রেনে কাটা পড়ে একজন, আর আত্দহত্যা করেছে এক স্কুলছাত্র, চাঁদাবাজদের হামলায় আহত হয়েছে ১০ জন, আর সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হয়েছে এক ছাত্রনেতা।

জুনে সারা মাসে দেশে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪ জন নারী ও ৬৪ জন শিশু। সারা দেশে একজন সাংবাদিক নিহত ও ১৪ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। এ ছাড়া ৩২ জন ইভ টিজিং এবং আটজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। ওদিকে হঠাৎ বন্যায় আর ভারতের আসাম-মেঘালয়ে অতিবৃষ্টির ঢলে নদীস্ফীতিতে অস্থির দেশের এক-পঞ্চমাংশ। মফস্বলে জলাবদ্ধতায় পানিবন্দী মানুষ বিপন্ন, রাজধানীতে মহানগরগুলোতে খাবার পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের হাহাকার। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী নির্বিকারচিত্তে একটা মনগড়া বিশাল ঋণনির্ভর বাজেট পেশ করে দলীয় এমপিদের বাহবা কুড়ালেন, যারা হাততালি দিলেন তারাও জানেন ওই বাজেট বাস্তবায়ন হবে না, গলাবাজি আর ভোটারদের মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়ার বুলি জোগাবে মাত্র। আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যে বাজেট পেশের দিন থেকেই শুরু হলো বিড়ম্বনা। বাজেট প্রস্তাব পেশের দিন যে দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করেছে, তা আর থামার লক্ষণ নেই। বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে শেয়ারবাজারে দরপতনের কোনো প্রভাব অর্থনীতিতে বর্তায় না বলে তিনি যে ফতোয়া দিলেন, তার ফলে সারা মাস শেয়ারবাজারের অধঃপতন আর থামল না। শেয়ারবাজার ডুবলেও বাজেটে যে কালো টাকা বিনিয়োগ (আর কালো টাকা তৈরিরও) ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে 'অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হতে চলেছে' বলে আপ্তবাক্য শোনালেন অর্থমন্ত্রী। আর যত দোষ নন্দ ঘোষ এই থিওরি অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদরা বলতে থাকলেন : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই উন্নয়ন, আর বিএনপি দেশকে শুধু হত্যা, ষড়যন্ত্র আর লাশ উপহার দিতে পারে, পদ্মা সেতুতে গোড়ায় বিএনপি-ই দুর্নীতি করেছিল বলে বিশ্বব্যাংকের অনুদান বন্ধ ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তির গেরো খুলেছে। এমন সময় নতুন সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষ দিনে বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, 'বিনা মেঘে বজ্রপাত' ঘটাল বিশ্বব্যাংক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশকদের অনলাইনে এবং বিবিসি রেডিও টেলিভিশনে ৩০ জুন ভোরে বহুভাষিক বিশ্বসংবাদে দুনিয়াকে জানান দেওয়া হলো_ বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল, দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে দীর্ঘ বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সেই ঋণ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে জারি করা বিশ্বব্যাংকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় ওই ঋণচুক্তি বাতিল করা হয়েছে। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্যে যোগসাজশে বিভিন্ন সূত্র থেকে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্বব্যাংকের হাতে এসেছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে এসব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়। তাদের প্রদত্ত তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেছিল বিশ্বব্যাংক। বলেছিল, যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সরিয়ে দিতে এবং অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ করতে। বিশ্বব্যাংকের এই অবস্থান ব্যাখা এবং বাংলাদেশ সরকারের জবাবের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিল না। বিশ্বব্যাংক একটি প্রকল্পে তখনই অর্থায়ন করতে পারে যখন তারা সেই প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যক্রমের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। 

এমন 'বজ্রাঘাতেও' সবজান্তা অর্থমন্ত্রীর বাক পারুষ্যের দম কমেনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল ঘোষণার সাত দিন আগে বুকের পাটা জাহির করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বললেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আমি কোনো বক্তব্য রাখতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে পারি, অপ্রমাণিত বিষয় নিয়ে (দুর্নীতির) কথা উঠছে। আমি একসময় বিচারিক হাকিমের দায়িত্ব পালন করেছি। তাই জানি, প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলা যায় না। প্রমাণ ছাড়া কারও নাম প্রকাশ করা নির্বুদ্ধিতা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্তের) ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না। কিছু এলে ওখানেই পাঠিয়ে দেই। তবে আমি এ কথা বলব, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়ে একটি অভিযোগও আসেনি। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) চুক্তিই অনুমোদন করে রেখেছে। কিন্তু কাজ বন্ধ। যেহেতু সবার একসঙ্গে কাজ করার কথা।

শেয়ারবাজার নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কমিটির প্রতিবেদনেও কিছু নাম এসেছিল। কিন্তু সাক্ষী নেই। একই জিনিস হয়েছে পদ্মার বেলায়। কিছু নাম এসেছে। প্রমাণের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণ আমার কাছে নাথিং (কিছুই না)। 

এখন পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর তিনি কয়দিন ধরে সকালে এক কথা, বিকালে এক কথা, আজ এক রায়, কাল আরেক রায় দিয়ে চলেছেন, যার মূল কথা তার কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কোনো দোষ নেই। সব দোষ বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রধান কর্মকর্তা রবার্ট জোয়েলিকের। নতুন প্রধান কর্মকর্তা মি. কিমের কাছে চিঠি লিখে তিনি সব ঠিক করে ফেলবেন। প্রথমেই তিনি বললেন, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি 'সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য'। বিশ্বব্যাংকের কায়দা-কানুন রীতিনীতি বা ভেতরের খবর তার নখদর্পণে এমন এক ভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, (বিশ্বব্যাংকের) বিবৃতিতে যে ভাষা এবং ভাব ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশ্বব্যাংক সে রকম বিবৃতি তাদের কোনো সদস্য দেশ সম্পর্কে দিতে পারে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মনে হয়, এটি বিশ্বব্যাংকের মন্তব্য নয়। এটি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী সভাপতি রবার্ট জোয়েলিকের ব্যক্তিগত মন্তব্য। পরদিন কিছুটা স্বর খাটো করে 'পদ্মাসেতু বিষয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে সরকারের বক্তব্য' পেশ করতে গিয়ে তিনি বললেন, 'বিশ্বব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করে পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যে ঋণচুক্তি দস্তখত করেছিল, সেটি বাতিল করা হয়েছে। তাদের বিজ্ঞপ্তিতে একটি অভিযোগ করা হয়েছে, একটি দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে বাংলাদেশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এতে বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে, তিনটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সম্মতি চেয়েও তারা পায়নি।

শনিবার আমি এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি প্রদানের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছি এবং সে জন্য তাদের বিজ্ঞপ্তিটি অগ্রহণযোগ্য মনে করেছি। আমি আরও বলেছি, 'পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তারা তুলে ধরেছে এবং সে সম্বন্ধে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেইনি'_ এ কথাটিও সঠিক নয়। তার পর পদ্মা সেতু নিয়ে অর্থায়ন বিশ্বব্যাংক বিগত বিএনপি সরকারের দুর্নীতির কারণেই বন্ধ রেখেছিল, সরকারিভাবে এই দাবি করে তার প্রচেষ্টায় কি করে ঋণচুক্তি সম্পাদিত হলো সেই কৃতিত্বের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের কাছে বার্তা দিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও রহস্যজনক। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি জারি করা অসম্মানজনক। বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আমরা তাদের পুনর্বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করব। 

পরদিন জাতীয় সংসদে বিবৃতি দিয়ে আবারও বিশ্বব্যাংকের ওপর দোষারোপ করে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, আমি জোরগলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, এই অর্থবছরেই আমরা পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব। বিশ্বব্যাংক অসমর্থিত বা অসম্পূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশকে এভাবে অপবাদ দিতে পারে না বা সে দেশের জনগণের মর্যাদাহানি করতে পারে না। 

অর্থমন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে সাংবাদিকদের বেনামি ব্রিফিং দেওয়া হলো_ পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমই এখন ভরসা, এ ভাবনা মাথায় রেখে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকার। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে। কিন্তু সেই আশারও বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে বিশ্বব্যাংকের নয়া প্রধান জিম ইয়ং কিম ৩ জুলাই সরাসরি বলে দিয়েছেন, পদ্মা সেতু বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের মঙ্গলের বিষয়ে আমরা সজাগ। কিন্তু বিশ্বব্যাংক কখনো দুর্নীতি সহ্য করে না। সেটাও দেখতে হবে।

দেশবাসীর প্রতিক্রিয়ার নমুনা প্রতিবেদনে এক সংবাদ ভাষ্যকার লিখেছেন, এক বছর ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সরকার যে অবস্থান নিয়েছিল বা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে বলে দাবি করেছে, তা আমাদের জনগণের কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম, আমাদের 'স্বাধীন' দুর্নীতি দমন কমিশন পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে খুবই দ্রুততার সঙ্গে একটি তদন্ত করল। এত দ্রুত এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক দুর্নীতির তদন্ত করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার 'সক্ষমতার' জন্য 'করিৎকর্মা' হিসেবে আমরা দুদকের প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু তদন্তের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নয়। ফলে দুদক যে তদন্ত করেছে এবং যে রায় দিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের কাছেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। বিশ্বব্যাংক তো অনেক পরের ব্যাপার!

দুর্নীতির তদন্তে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তিনটি শর্ত, সন্দেহভাজনদের সাময়িক 'ছুটি' (বরখাস্ত নয়) দিয়ে দূরে রাখা, দুদকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষ টিম গঠন করা এবং বিশ্বব্যাংক নিযুক্ত একটি উপদেষ্টা প্যানেলকে তদন্তের সর্ববিষয়ে অবহিত রেখে পরামর্শ নেওয়া, সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সংসদে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছেন, এ প্রস্তাবগুলোতে সমস্যা হচ্ছে যে, আমরা কোনো কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই দুর্নীতির দায় স্বীকার করে নিচ্ছি।

প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যে কোনো দুর্নীতির তদন্তে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম যে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের তদন্তের স্বার্থে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে দুর্নীতি স্বীকার করে নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে দুদকের তদন্ত যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, বিষয়টি যে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিশেষভাবে তদন্ত করা উচিত, সে দাবি তো দেশের ভেতর থেকেই উঠেছে। আর আন্তর্জাতিক যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে এবং যে প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তারা সেখানে স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এ তিনটি শর্তের ভিত্তিতে তদন্ত করে যদি প্রমাণ করা যেত বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতি হয়নি, সেটাই কি সবচেয়ে ভালো পথ ছিল না? বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশ অপমানিত হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই অপমানের দায় কার? অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমি জোরগলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি। তা-ই যদি হয়, তবে দেশের ভেতরেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে যে বিচারিক তদন্তের দাবি উঠেছে, তা মানতে সমস্যা কোথায়?

এসব প্রশ্নের সদুত্তর নেই। তবে মিডিয়ায় বাগযুদ্ধে মোটেও পিছপা হননি অর্থমন্ত্রী ও অন্যান্য ক্ষমতাসীন নেতা-মন্ত্রীরা। যোগাযোগমন্ত্রী বললেন, পদ্মা সেতু নিয়ে 'চমক' আছে, 'সারপ্রাইজ'-এর অপেক্ষা কর। পরে বিশ্বব্যাংকের নয়া প্রধান জিম ইয়ং কিমের মুখে 'ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক' এ কথা শোনার পর যোগাযোগমন্ত্রী বললেন, 'সারপ্রাইজ' কথাটা বলা ভুল হয়েছে। বিরোধী দলনেতা বেগম জিয়া সাফ বললেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার জড়িত বলেই এত গড়িমসি, পদ্মা সেতু হতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে এক আওয়ামী শীর্ষ নেতার হুমকি_ ওই কথা ফিরিয়ে নিন, না হলে সারা দেশে জেলায় জেলায় একসঙ্গে দলের ওস্তাদ মামলাবাজরা মানহানির মামলা ঠুকে হয়রানির চূড়ান্ত করবে। বিএনপির এক শীর্ষনেতা জবাবে বললেন, মুরাদ থাকে তো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করুন। দেশের লোক ভাবছে, জাতিরাষ্ট্রের ভাগ্য নিয়ে কি তামাশা ফেঁদেছে রাজনীতিকরা!

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

রক যখন ভক হয়

রক যখন ভক হয়



॥ সাদেক খান ॥

সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত ৫২,০৬৮ কোটি টাকার ঘাটতিসহ ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকার বিশাল বাজেট এখন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন টকশো আর নব্য ধনী গৃহে অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আরো আলোচ্য, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ‘বাড়াবাড়ি’ কিভাবে ধরপাকড় করে, জেলে পুরে, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, মামলা-হামলায় শায়েস্তা করা হচ্ছে। প্রথমোক্ত বিষয়ে সরকার বাহাদুরের তরফে অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা : বাজেট মোটেও বিশাল নয়, ঘাটতিও তত বেশি নয়। লুকানো কালো টাকা সাফ করে জাহির করার যে ঢালাও সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে তার সাফাই : ‘কালো টাকাকে আমি কালো বলি না, বলি অপ্রদর্শিত আয়। এ টাকা অবশ্যই বিনিয়োগের মধ্যে আনতে হবে।’ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৮ থেকে ৮২ শতাংশ এখন অপ্রদর্শিত আয়। পরপর তিনটি বাজেটে ধারাবাহিক শেয়ার কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংকিং ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় নানা ধাঁচের ফন্দিফিকির ‘রিশবৎ’ আদায়ের সুযোগ করে দিয়ে হাস্যমুখ অর্থমন্ত্রী রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। কালো টাকার কুমিরদের সংখ্যায় ও টাকার ওজনে তিনিই প্রশ্রয় দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দৈত্য বানিয়ে ফেলেছেন। আর তারা যে জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৮২ ভাগ পর্যন্ত দখল করে এখন চেপে বসেছে, এ কথা বলতে একটুও লজ্জাবোধ করলেন না বেশরম অর্থমন্ত্রী।
এখানেই মো দেননি পোবাবু অর্থমন্ত্রী। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণফোনের বদৌলতে গ্রামেগঞ্জে মোবাইল ফোন চালু হয়ে সস্তা চীনা মুঠোফোন কিনতে পেরে দেশের আনাচে-কানাচে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে গরিবের জন্য। মুঠোফোনে লেনদেন হয়, কেনাবেচা হয়, দূরালাপনি স্বাস্থ্যসেবা হয়, সুখে-দুঃখে প্রবাসী রোজগেরে স্বামী-পুত্র-কন্যার সাথে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামেগঞ্জে দুই-চারটে মুঠোফোন দিয়েই হাজারো পরিবারের সেবা হয়। প্রত্যন্ত এলাকায় সাইকেলে ঘুরে ঘুরে কিংবা দোকানে বসে দরিদ্র মুঠোফোনকর্মী সেবা বিতরণ করেন। শুধু অসমর্থ, বৃদ্ধ বা বিপন্ন ব্যক্তির জন্য নয়, কর্মব্যস্ত েেতর কৃষক, সেলাইঘরের দর্জি, মাছের বাজারের জেলে, নৌকার মাঝি, ঘাটের মুটে, বাড়ির বউ, ছেলেমেয়ের মা, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, দিন-আনা দিন-খাওয়া সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনিতে যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেসব মেহনতি মানুষের দোরের কাছে বরকত হয়ে পৌঁছেছে মুঠোফোনসেবা। এখন খামখেয়ালি অর্থমন্ত্রী হুকুম জারি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, যাতে একজন মুঠোফোন ব্যবহারকারী ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সাথে সাথে দুই টাকা কর হিসেবে কেটে রাখা হবে। করলেন খরচ, হয়ে গেল আয়। এমন আয়কর বসানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী যে, মুঠোফোনে কথা বললেই কর দিতে হবে। আমরা এর আগে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বা ঠিকাদারি ব্যবসায়ে মাল ছাড় বা বিল ছাড়ের সময় সম্ভাব্য মুনাফার শতাংশ হিসাব করে অগ্রিম ‘উৎসে কর’ কেটে রাখার ব্যবস্থা দেখেছি। করদাতা মুনাফা কম হয়েছে বা লোকসান হয়েছে দেখাতে পারলে বছর শেষে পুরো ব্যবসার আয়কর থেকে তার রেয়াত বা উৎসে কর ফেরতেরও বিধান রয়েছে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের জন্য ওই আয়কর ব্যবস্থায়। এখন স্বল্পবিত্ত বা বিত্তহীন মেহনতি মানুষের সামান্য আয়ের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের বোঝা তো আছেই, মোবাইল ফোনে কথা বলাকেও গরিবের ঘোড়ারোগ সাব্যস্ত করে ‘ব্যয়ের ওপর আয়কর’ বসিয়েছেন জালেম সরকারের জ্ঞানপাপী অর্থমন্ত্রী। মহাজোটের তল্পিবাহক বামরাজনীতিবিদেরা অর্থমন্ত্রীর কাছের লোক। তারাও বলতে বাধ্য হয়েছেন, এই বাজেটে কেবল ধনী ও লুটপাটকারীদের স্বার্থ রা করা হয়েছে; কালো টাকার মালিক ও লুটেরা ধনীদের স্বার্থ রাকারী এই বাজেট তারা মানেন না। তাদের মুখে এটুকু যে বিষ নেই সাপের কুলোপানা চক্কোর, তাও ভালো। জবরদস্তি চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে কুলোপানা পিঠ পাবলিকের সেই মাজার জোরটুকুও নেই। অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব নির্বাচনী এলাকারই একজন রসুন বিক্রেতার ীণ প্রতিবাদের ভাষা : ‘বাজেট ঘোষণা অইলেই কিতা (হলেই কি), না অইলেই কিতা। আমরার মতো মানুষের চলিয়া খাওয়ার কোনো প্রসেস (উপায়) নাই। বাজেট অইলে সবগুলা জিনিসের রেইট (দাম) বাড়ে। কোনো দিন বাজেট অইছে, আর জিনিসের দাম কমছে, এটা দেখি নাই।’
অঢেল কালো টাকার মালিক ছাড়া ধনী ব্যবসায়ীরাও খুশি নন ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। শিল্প বাণিজ্য চেম্বার ও সমিতিগুলোর শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদের ভাষায় : বাজেট বরাদ্দের জন্য সরকারের চাহিদা মিটাতে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার যে আভাস দেয়া হয়েছে, তাতে বেসরকারি খাত নানামুখী সমস্যায় পড়বে। সরকার ব্যাংক থেকে বেশি হারে ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না এবং পুঁজি সঙ্কটে পড়বে। ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার আরো বেড়ে যাবে।
অর্থমন্ত্রীর মতো সাবেক ‘সিএসপি’ মর্যাদার আর্থিক প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা কিংবা তারই মতো বিশ্বব্যাংকে চাকরি-ফেরতা সামষ্টিক অর্থবিদ্যায় চৌকস ব্যক্তিরা অথবা অর্থমন্ত্রীর হিতৈষী বাজেট বিশ্লেষণপটু থিঙ্কট্যাঙ্ক তথা মাথাওয়ালা পঞ্চক প্রায় কেউই অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় সম্মত হতে পারছেন না। বলছেন, সাধ্যের মাপকাঠিতে এটা আদপেই বিশাল বাজেট, ব্যাকরণসিদ্ধ (কেউ কেউ বলছেন ব্যাকরণসর্বস্ব), কিন্তু বাস্তবসম্মত নয় (কেউ কেউ বলছেন একেবারেই লোক দেখানো বাজেট; নির্বাচনী প্রচারের জন্য, বাস্তবায়নের জন্য নয়)। বাজেট ঘাটতিও যতটা দেখানো হয়েছে, দাঁড়াবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর রাজস্ব সংগ্রহের রেকর্ড বলে দেয়, প্রাক্কলিত রাজস্বের ল্যমাত্রা পূরণ হবে না। এ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর বৈদেশিক সহায়তা সদ্ব্যবহারের বা ছাড় পাওয়ার অমতার রেকর্ড বলে দেয়, বৈদেশিক সাহায্যের যে অঙ্ক দেখানো হয়েছে সেটাও ঘরে আসবে না, কাগজে-কলমেই লেখা থাকবে।
যদি নির্বাচনী প্রচারে কৃতিত্বের ফর্দ বাড়ানোর তাগিদে সুশাসনে ব্যর্থ স্বেচ্ছাচারী আত্মসেবী গণবিমুখ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আদপেই বাজেট বাস্তবায়নের এরাদা থাকে, তবে দেখা যাবে রাজস্বের কমতি প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যে কমতির এবং শূন্য পূরণ করতে দেশের ব্যাংকগুলো থেকেই সরকারকে আরো ধার করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য সঙ্কট ডলার সঙ্কট আরো বাড়বে। কালো টাকার মালিকরা বিদেশে জমানো ডলারের গোপন পুঁজি বিনা জিজ্ঞাসায় দেশে নিয়ে এসে নতুন লাইসেন্স পাওয়া আওয়ামী ব্যাংকগুলোকে চাঙা করবে, এমন যে আশার কথা অর্থমন্ত্রী বড় গলায় বলে চলেছেন, সেই আশাবাদের মুখেও ছাই পড়বে যদি না রাজনৈতিক সঙ্ঘাত আর অপরাধবৃত্তের প্রতাপ রোধ না করা হয়। 
সুশীল সমাজের মুরব্বিদের তরফে এমন হুঁশিয়ারির জের ধরে এবার দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়ের কথায় আসা যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশের আগের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২২০৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে সমাবেশকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৫০ জনকে। বরিশাল থেকে লঞ্চ এবং বগুড়া থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। দণিাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোতে যাত্রীবোঝাই করে যেতে দিয়ে ঢাকায় ফিরতে নিষেধ করা হয়। কয়েকটি জেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বহন করা গাড়ি আটকে দেয়া হয়। কোথাও কোথাও ভাড়া করা গাড়িগুলোর ভাড়াচুক্তি বাতিল করতে বাধ্য করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অহেতুক তল্লাশির নামে হয়রানি এবং ঢাকা অভিমুখে বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চলে। ঢাকার বাইরের আগন্তুকদের হোটেলের কামরা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে এক ত্রাসের ডামাডোল সৃষ্টি করেছে সরকারেরই পুলিশ বাহিনী। সমাবেশের দিন ১১ জুন সকাল থেকেই রাজ্যের পুলিশ রাস্তায় নামিয়ে ঢাকার প্রবেশমুখ গাজীপুরের চন্দ্রা, সদরঘাট, বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ করে দিয়ে ঢাকামুখী মানুষের গতিরোধ করা হয়। রাজধানী শহরের ভেতরে গণপরিবহন চলাচল কমে যায় বা বন্ধ রাখা হয়। যানজটের শহর ঢাকায় হরতালের অবস্থা সৃষ্টি হয়।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। অফিসগামী ও অফিসফেরত মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। ব্যস্ত ভিআইপি সড়কে চলেছে রিকশা ও রিকশাভ্যান। অনেককে ভেঙে ভেঙে এসব যানে গন্তব্যে পৌঁছাতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। অল্প কিছু বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব চলেছে। পুলিশ হয়রানির ভয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচলও ছিল সীমিত।
যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ুব্ধ মানুষ সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়ে মহাসড়কে দু’টি বাস ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে সরকারসমর্থক পরিবহন শ্রমিকেরা। আটকা পড়া যানবাহনে কাগজপত্র পরীার নামে হয়রানি চলে। সারা দিন উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো বাস ঢাকায় আসতে পারেনি। কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ থেকে খোলামোড়া পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর শতাধিক খেয়াঘাটের নৌকা চলাচলে বাধা দেয় শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। বাধা উপো করে যারা নৌকা নিয়ে বের হয়েছিল, তাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে লাঠিপেটা করে শ্রমিক লীগের কর্মীরা। সদরঘাটে অনেক লঞ্চও ভিড়তে পারেনি। তল্লাশি পুলিশ ‘তুই বিএনপি, তুই বিএনপি’ বলে শুধু বাস নয়, মোটরসাইকেল আর মোটররিকশা থেকেও লোক নামিয়েছে। যাকে ধরেছে তার মানিব্যাগ, দামি জিনিস কিছু সাথে থাকলে কেড়ে নিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বলেছে। কাউকে কাউকে চড়চাপট দিয়ে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৮-দলীয় বিরোধী জোটের ৩০ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ঢালাও দাঙ্গা-মামলায় হুকুমের আসামি হিসেবে অনেকে দুই সপ্তাহের বেশি জেলে আটক। হাইকোর্টে তাদের জামিন হলেও ইতোমধ্যে অন্য মামলা ঠোকা হয়েছে, সে মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট বা নিম্ন আদালতে হাজির করানোর আদেশ জারি করে তাদের অনেককে জেলেই পুলিশ হেফাজতে আটকে রাখা হয়েছে।
তবু ধরপাকড়, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ১৮-দলীয় মহাসমাবেশ হয়েছে। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মঞ্চ করে আশপাশের রাস্তাজুড়ে প্রায় অর্ধদিবস ধরেই সভা চলেছে। গণসমাবেশ থেকে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে তার দেয়া চরমপত্র বা আলটিমেটাম ১০ জুন তামাদি হওয়ার পর সেই চরমপত্রের মেয়াদ আরো বাড়িয়ে ঈদ পর্যন্ত সরকারকে সময়-সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রমজানের আগে কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে ঈদুল ফিতরের পর হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। আলোচনার অবকাশ বিস্তৃততর করে বলেছেন, “আলোচনার মাধ্যমে ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। আশা করি, সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। দাবি আদায় না হলে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার হবে। আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য করতে আরো বিস্তৃত করা হবে।” চলতি পর্যায়ে ১১ জুনের গণসমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া পাঁচ দিন দেশব্যাপী বিােভ সমাবেশের ঘোষণা দেন। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে আছে : নির্দলীয়-নিরপে সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ১৭ জুন সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় বিােভ সমাবেশ। জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো, কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস, রফতানি পণ্যের উৎসে কর বৃদ্ধি, ঋণনির্ভর ও গণবিরোধী বাজেটের বিরুদ্ধে ২৪ জুন, ইলিয়াস আলীসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মী-ব্যবসায়ী অপহরণ, সাংবাদিক সাগর-রুনি ও কূটনৈতিক হত্যা এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা, নারী-শিশু নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে ১ জুলাই, সন্ত্রাস-দুর্নীতি, দুঃশাসন, বিদ্যুৎ-পানির সমস্যা, অসহনীয় যানজটের প্রতিবাদে ৮ জুলাই এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৫ জুলাই সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় সমাবেশ ও বিােভ মিছিল। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৫ জুলাইয়ের কর্মসূচি থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেয়া হবে। তবে প্রয়োজনে ঈদের আগে কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা দেয়া বন্ধ করুন। নইলে এর দায় আপনাদের বহন করতে হবে।’
সরকারের পুলিশি বাধা খাড়া করার সাফাই গেয়ে মতাসীনদের পে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। প্রকারান্তরে বলেছেন, ওই ওষুধে কাজ হয়েছে। বলেছেন, “বাস্তবতা উপলব্ধি করে বিরোধী দলনেতা রণেভঙ্গ দিয়ে ‘কঠোর কর্মসূচি’ থেকে সরে এসেছেন।” সাধারণ পাবলিক বলছে : মানুষকে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের কষ্টের ওপর পুলিশি জুলুমের কষ্ট দিয়ে সরকারের ওপর পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছেন তারা, সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন কি মতাসীন দলের নেতারা? বিরোধী দল বিএনপি সমাবেশ করে, আর সেজন্য পুলিশ পিকেট দিয়ে ঢাকা অবরোধ করে বাসযাত্রী, মোটর, রিকশা যাত্রীকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে মারধর করে হরতালের দুর্ভোগ ভোগায় খোদ সরকার। এ কোন মগের মুল্লুকে বাস করছি আমরা? রক যখন ভক হয় তখন নিরীহ গরিব মানুষ দুর্গতি ছাড়া আর কী আশা করতে পারে? 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন



॥ সাদেক খান ॥

গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ 
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন



॥ সাদেক খান ॥

গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ 
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বুধবার, ৩০ মে, ২০১২

আর্থরাজনৈতিক বিভ্রমের ঘোরে বাংলাদেশ


॥ সাদেক খান ॥


পুরোদস্তুর লুটেরা রাজত্বেও বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। ধাপে ধাপে চাঁদাবাজির খেসারত দেয়ার পরেও মেহনত দিয়ে, উদ্ভাবনী মেধা দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজ নিজ পরিধিতে উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। তবে অবকাঠামো খাতে কোনো উন্নয়ন না হওয়ায়, টাকার দরপতন, শেয়ার কেলেঙ্কারি, বিদ্যুৎ সঙ্কট, ব্যাংকিং বিভ্রাটের কারণে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ থমকে থাকায়, উচ্চমহলের দুর্নীতির চাপে বৈদেশিক ঋণ বা বিনিয়োগ বাংলাদেশবিমুখ হওয়ায় এই প্রবৃদ্ধির হার জনজীবনের চাহিদা আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে যৎসামান্য, দারিদ্র্য নিরসনের কষ্টিপাথরে নেতিবাচক বলেই সাব্যস্ত হতে পারে। তবে একই সাথে বলতে হয়, প্রতিকূল বিনিয়োগ পরিবেশ আর দুঃশাসনের পীড়ার মধ্যেও এ দেশবাসী যে প্রবৃদ্ধির গতিবেগ ধরে রাখতে পেরেছে, সেটাই বলে দেয় যথার্থ বিনিয়োগ পরিবেশ আর সুশাসন কায়েম হলে এ দেশের প্রবৃদ্ধির কী বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যেতে পারে।
১৭ বছর পর বাংলাদেশে ঝটিকা সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন সেই ‘বিপুল সম্ভাবনা’-র কথাই বলে গেলেন। বলেছেন : ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশীলসমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। শিাব্যবস্থাও শক্তিশালী হচ্ছে, শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরা মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনীতিতেও একটি গুরুত্ব বহনকারী দেশ হিসেবে নাম কিনেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিভিন্ন সূচকের মধ্যে বাংলাদেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার কমে আসছে, দারিদ্র্য দূর করার পদপে নেয়া হচ্ছে। এ সব কিছুর জন্য বাংলাদেশের মানুষেরই প্রশংসা করতে হবে, যারা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করছেন।’
সরকারি হস্তেেপর নীতিবিভ্রাটে দরিদ্র সঞ্চয়ীদের পুঁজিতে গড়ে ওঠা ‘অনন্য’ ুদ্রঋণ সংস্থা গ্রামীণ ব্যাংকের বিড়ম্বনার কথা ওঠায় তিনি আরো বলেন, ‘আমি আশা করি গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্যের ধারাবাহিকতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে যদি এ দেশের সরকারের কোনো পদেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংক তিগ্রস্ত হয়।’
বাংলাদেশের স্তুতিবাদই করছিলেন হিলারি। তার কথায় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ওই সামান্য মতান্তরেই ফুঁসে উঠলেন ‘অনুদার গণতন্ত্রচর্চা’-র সাাৎ মাস্টারমশাই শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অকারণ ঝগড়া বাধিয়ে বসলেন তার মুরব্বি ভারতশক্তির মুরব্বি একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। বিষদাঁতের ছোবল মেরে বললেন, হিলারির বক্তব্য অনাকাক্সিত, গ্রামীণ ব্যাংকে এক টাকাও দেয়নি বিশ্বব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংকে বিশ্বব্যাংক টাকা দেয়নি, দেয়ার কথাও নয়। কারণ বৃহৎ ঋণেই উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়নম করতে বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের পুঁজির শতকরা ৯৭ ভাগই তো ুদ্রঋণগ্রহীতা সদস্য ও সঞ্চয়ীদের। তাদের মালিকানা অর্থমন্ত্রী অস্বীকার করছেন না কেন? আইনি ভিত্তি ছাড়াই কেন মিথ্যা দাবি করছেন, গ্রামীণ সরকারি ব্যাংক? 
এর আগে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বৈদেশিক ঋণদাতা প্রায় সবাইকেই বৈরী করে তুলেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির জাল সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক তার একটা প্রাথমিক জরিপ ও তদন্ত রিপোর্ট অর্থ মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করে। তার জেরে সংশ্লিষ্ট দু-চারজন কর্মকর্তাকে তলব আর জেরা করে কোনোরকম গোয়েন্দা তদন্ত ছাড়াই দুদক (ওপরের নির্দেশে?) দায়সারা একটা রিপোর্ট দিয়ে বলে, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতির প্রমাণ নেই, তা ছাড়া মূল প্রকল্পই শুরু হয়নি। সেই সাফাই রিপোর্টের ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে দুষলেন, যে প্রকল্প শুরুই হয়নি সেখানে দুর্নীতির গন্ধ আবিষ্কার করে বিশ্বব্যাংক ভণিতা করছে। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক কানাডার ‘মাউন্টেড পুলিশ’-এর তদন্ত রিপোর্ট উদ্ধৃত করে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানাল, পরামর্শক নিয়োগে মোটা অঙ্কের আগাম উৎকোচ দাবি করা হয়েছে; পরামর্শক নিযুক্ত হয়ে সেই উৎকোচ প্রদানও করেছে একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান। ব্লগ সূত্রে প্রকাশ, যে দুজনের ব্যাংক হিসাবে সেই অর্থ পাঠানো হয়েছে, তাদের অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ উৎকোচের জমারশিদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমরা দুর্নীতির প্রমাণ দিয়েছি। অথচ ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ অর্থমন্ত্রী এখনো তোতাপাখির মতো বুলি আওড়ে চলেছেন : পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি; বিশ্বব্যাংকের ‘সন্দেহ’ অমূলক। ফলাফল : বৈদেশিক সহায়তার ছাড় না পেয়ে গেল বছরের উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট, নতুন অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেট মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। 
অর্থনীতির হালের কথায় ফেরা যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। চলতি অর্থবছরে (২০১১-১২) জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ হবে। তবে মাথাপিছু দেশজ উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ৭৭২ মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭১। বিবিএস সূত্র মতে, আমদানি শুল্ক বাদ দিয়ে জিডিপি পরিমাপের প্রধান ১৫টি খাত ধরে হিসাব করে এর প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। বিবিএস আরো বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে স্থিরমূল্যে জিডিপির আয়তন দাঁড়াবে চার লাখ নয় হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। আর চলতি মূল্যে এর আয়তন নয় লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বিবিএস যে হিসাব প্রাক্কলন করেছে, সেটাও বেশি মনে হচ্ছে। কেননা রফতানি কমেছে। আবার মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও কমেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে।
অন্য দিকে চলতি অর্থবছরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে।
এই প্রাক্কলিত পরিসংখ্যান নিয়েও গোলমেলে চিন্তায় চ্যাম্পিয়ন অর্থমন্ত্রী মুহিত তারই অধীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এখন বিবাদ বাধিয়ে বসেছেন। তিনি দাবি করছেন : জিডিপির পরিমাণ কম করে দেখানো হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে অপোকৃত ভালো পরিসংখ্যানব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই জিডিপি যথাযথভাবে নিরূপণ করা হয় না। আরো বলেছেন : ‘জিডিপি শুধু কম নিরূপিত হয় না, এটা ভয়াবহ রকম কম নিরূপিত হয়। প্রায় ১৫ বছর পর দেশে নতুন পরিসংখ্যানব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এতে সব তথ্য-উপাত্ত নতুন করে সংশোধিত আকারে দেখা সম্ভব হবে।’
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব প্রাক্কলনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, বিবিএস বা এডিবির প্রাক্কলন থেকে কিছুটা বেশি মাত্র, তবে পূর্বঘোষিত ল্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৫% বা আধা শতাংশ কম। এ নিয়ে বিবাদে কী লাভ? 
জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি প্রসঙ্গেই আদমশুমারি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, পঞ্চম আদমশুমারি পুনর্নিরীণ করে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৮০ লাখ হয়েছে। গত চারটি আদমশুমারির তুলনায় এবারের আদমশুমারি অনেক ভালো হয়েছে। আরো বলেন, জাতিসঙ্ঘ পরিবার পরিকল্পনা সংস্থা (ইএনএফপিএ) প্রদত্ত জনসংখ্যার হিসাব ঠিক নয়; এ দেশে প্রস্তুত পরিসংখ্যান নিয়েই এখন থেকে চলতে হবে, ইউএনএফপিএ-র জরিপের দিন ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ যেন গায়ে পড়ে জাতিসঙ্ঘের সঙ্গেও অকারণ ফ্যাসাদ বাধাবার তক্কে আছেন অর্থমন্ত্রী।
এখন শেখ হাসিনা সরকারের বলা যায় পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন-পূর্ব শেষ বাজেট দিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। তাতে নির্বাচনমুখী নানা আজগুবি প্রকল্প, নানা বাগাড়ম্বর থাকছে সেটা স্বাভাবিক, সেসব বাস্তবায়নযোগ্য হবে কি না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। লোকে শুধু ভয় পাচ্ছে অর্থমন্ত্রী নয়া বাজেটে আরো কালো টাকা সাদা বানানোর বাড়তি সুযোগ দিয়ে এবং মোটা চাঁদাবাজ আর শেয়ারদস্যুদের সেসব টাকা বেবাক বিদেশে পাঠানোর নানা ফাঁকফোকর শেষবারের মতো তৈরি করে দিয়ে দেশের নাজুক অর্থনীতির আরো কত সর্বনাশ ঘটাবেন।
এরই মধ্যে রাজনৈতিক গুমোটও বেশ পাকিয়ে উঠেছে। তার সংপ্তি একটা বিবরণ এসেছে বিলেতের বিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকায় এক জোড়া প্রতিবেদনে। তার একটির শিরোনাম : ‘বাংলাদেশে রাজনীতি, এদিকে-ওদিকে ঠুকে মরছে (সে দেশের মানুষ)’। আরেকটির শিরোনাম : ‘বাংলাদেশের বিষাক্ত রাজনীতি’। সারকথা : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে ভয়ঙ্কর পথে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতই পারে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটানো থেকে নিবৃত্ত করতে। কারণ ঢাকার (বর্তমান সরকারের) ওপর প্রভাব রয়েছে একমাত্র রাষ্ট্র ভারতের। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র চাইলে দিল্লির উচিত হবে সে জন্য আরো জোর দিয়ে (শেখ হাসিনার কানে) কথা বলা।
দি ইকোনমিস্টের দুই সংবাদভাষ্যকারের কাছে যে কথা স্পষ্ট নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে যেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, সেটা এই যেÑ দিল্লি বাংলাদেশে ‘কার্যকর গণতন্ত্র’ চায় না, একটা বাধ্য সরকার চায়। হাসিনাকে সুপরামর্শ দেয়ার কোনো নিয়ত ভারতশক্তির নেই, বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র সাব্যস্ত করাই তার ল্য। এ দেশবাসীর কাছে দিল্লির এমন মতলবের অকাট্য প্রমাণ, বারবার উচ্চপর্যায়ে প্রতিশ্র“তি দিয়েও সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না, বেড়েই চলেছে; টিপাইমুখ নিয়ে দুইমুখী কথা বলে নদী-পরিবেশ নাশ আর ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে ওই বাঁধের কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে; বারবার তারিখ দিয়েও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে না; স্বীকৃত স্থলসীমান্ত মীমাংসার কাজ ঝুলে আছে। দিল্লি যে এখন দুই দিকেই উসকাচ্ছে, তারও একটা ইঙ্গিত আছে ওই জোড়া রিপোর্টে। তাতে আরো বলা হয়েছে : 
“সাধারণ নির্বাচনের ১৮ মাস বাকি। এ সময় বিরোধী দল রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যস্ত। বিরোধী নেতাদের বড় অংশকে জেলে পাঠানো হয়েছে। নিখোঁজ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। ধারণা করা হয় এর পেছনের কারণ পুরনো শত্র“তা। নির্বাচন কে পরিচালনা করবে তা নিয়ে উভয় পরে মধ্যে বিতর্ক। এ ছাড়া বাংলাদেশে খাদ্যমূল্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, লাগাতার বিদ্যুৎসঙ্কট, সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ তো রয়েছেই।
“বেশ কয়েকটি রহস্যজনক গুমের ঘটনা ঘটেছে। এক মাস আগে বিএনপির এক রাজনীতিক অপহৃত হয়েছেন এবং সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে আরো দুজনকে খুন করা হয়। সহিংসতার অভিযোগে ৩৩ জন রাজনীতিককে জেলে ঢোকানো হয়েছে, যাদের মধ্যে সিনিয়র এমপিরাও রয়েছেন। এর ফলে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আরো কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনা রয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি বেশ কিছু রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একজন সৌদি কূটনীতিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের পর এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে খুন করা হয়। দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করায় সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করা হয়। 
“জানুয়ারিতে ছিল ব্যর্থ অভ্যুত্থানের গুজব, যা সেনাবাহিনীর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ল্েয ব্যবহার করা হয়।
“পরবর্তী নির্বাচন কার তত্ত্বাবধানে হবে এবং তা আসলেই নিরপে হবে কি না তা নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এটা ইতোমধ্যে এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, অনেক পর্যবেক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশীরা ইতোমধ্যে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য, মারাত্মক লোডশেডিং এবং নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্র“তি ভঙ্গে ুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
“সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। দাতাদের প থেকে দুর্নীতির অভিযোগ তো আছেই; পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক সাহায্য বন্ধ করেছে। এ বিষয়ে উপপ্রধানমন্ত্রী পাঠিয়ে জাপান সুরাহা করার তাগাদা দিয়েছে। রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ তার সহকারীর গাড়িতে টাকাভর্তি ছালার ব্যাগ উদ্ধার করেছে। ওই মন্ত্রীকে ক্যাবিনেটে পুনর্বহাল করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ একটি তদন্তের মাধ্যমে তাকে নিষ্কলুষ করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্রের নিরেপতা বহাল থাকা নিয়ে বড় রকমের সংশয় রয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ সপ্তাহে হিলারি কিনটনের হুঁশিয়ারি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ বিরোধী দলের অংশগ্রহণ যেন থাকে।
“বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বহির্বিশ্ব কিছুটা চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে এসেছে, ইউনূসের প্রতি অসদাচরণ ও হয়রানিমূলক তৎপরতার নিন্দা করেছেন ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রদূতেরা। 
“কিন্তু সরকারকে অনড় মনে হচ্ছে। হিলারির প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করতেই যেন সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করছে, এর মাধ্যমে ব্যাংকটির মালিকানা সরকার নেবে কিংবা ধ্বংসও করে ফেলতে পারে।”
মন্তব্য নি®প্রয়োজন। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

দমননীতি নির্ভরতা : গুম আতঙ্ক ও জনবিক্ষোভ

গুম আতঙ্ক ও জনবিক্ষোভ



॥ সাদেক খান ॥

জলাতঙ্কের মতোই প্রাণভয়ের ‘মহামারী’ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই হরতাল নিয়ে সরকার প যত কথাই বলুক না কেন, অরাজক পরিস্থিতি নাগরিক অব্যবস্থার নিত্যনৈমিত্তিক কষ্টের ওপর আরো কষ্ট স্বীকার করে শহরবাসী দু-চার দিন বিরতি দিয়ে একটানা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে স্বেচ্ছায়ই শামিল হচ্ছে বলতে হবে। পিকেটিং নেই বললে চলে, রাজপথ দখলে রাখছে পুলিশের টহল আর সরকার পরে দলীয় বাহিনীগুলোর হরতালবিরোধী মিছিল। হরতালের পে মিছিল বেরোলেই পুলিশের ব্যারিকেড টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ আর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রলীগের ‘লাঠি-বৈঠা’ হামলা। তবু হরতাল হচ্ছে। বিএনপি হরতাল ডাকছে, ১৮ দলীয় জোটের শরিকরা সমর্থন জোগাচ্ছে। হরতালের সময় নগরে বন্দরে মফস্বল শহরে লোক চলাচলে বিভ্রাট কিংবা দূরপাল্লার যাত্রী দুর্ভোগ অসহনীয় হয়ে উঠছে। দৈনন্দিন কাজগুলো লোকে সন্ধ্যায় মেটাচ্ছে, ছুটির দিনে কাজ করছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কাজ জুটছে না, আহারও জুটছে না। সন্ধ্যায় কিছু কাজ করে যা পাওয়া যায় তা নিয়ে চলতে হচ্ছে। তবুও হরতাল হচ্ছে কারণ প্রাণভয় ুধার তাড়নার চেয়েও বেশি অস্থির করে তুলেছে সর্বশ্রেণীর মানুষকে।
জাতিরাষ্ট্রের দায়বদ্ধ সমাজজীবনে প্রশাসন, আদালত, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, বহুদলীয় রাজনীতি, পুঁজিবাজার-ব্যাংক বীমা, মুদ্রাব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্যব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা ও সর্বোপরি জননিরাপত্তা ইত্যাকার যেসব শৃঙ্খলা দেশবাসীকে নাগরিক আস্থা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মেলবন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিল, সেই বন্ধন এখন টুটে যাওয়ার উপক্রম ঘটেছে। একই সাথে ঐতিহাসিক বিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূরাজনৈতিক ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার নানা টানাপড়েনের মধ্যেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে যে স্বাজাত্যাভিমানকে এ দেশবাসী সযতেœ ধরে রেখেছিল, তার মনোবলের তন্ত্রে কিছুর মূলে কুঠারাঘাত ঘটছে অবিরত। রাষ্ট্রঘাতী দেশজ মীরজাফর চক্র আর বহিঃশক্তির সশস্ত্র গুপ্তচর দল মিলে গুম-খুন আর দুর্ধর্ষ অপরাধী তৎপরতার বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে। তার রাজনৈতিক উত্তাপের সাথে নিত্যব্যবহৃত পণ্যের অগ্নিমূল্য, বাড়ি-গাড়ির ভাড়া বৃদ্ধির উৎপাত, বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সেচ বন্ধ, পানির কল বন্ধ, পাখা বন্ধের যন্ত্রণা আর গ্রীষ্মের উত্তাপ মিলে জনজীবন দুর্বিষহ।
এসবেরই যোগফল হরতালের নীরব প্রতিবাদ। অপহৃত রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী তার উপল, তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের জন্য রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। অন্য দিকে সরকার পওে দোষারোপ আর বিভ্রম সৃষ্টির নানা চাল সমানে চালা হচ্ছে। তাই সন্ধানী সাংবাদিকতা কিংবা নিছক গুজব থেকে যে রহস্যের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকারেরই চোখের জ্বালা বাড়ছে। প্রথম থেকেই বিরোধী জোট সন্দিগ্ধ যে সরকারের কোনো সংস্থা ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ পাকড়াও করে ওই নেতাকে নিয়ে গেছে; এরপর কাগজে জবরদস্তি সই করিয়ে হয় আদালতে মামলা দেবে, না হয় ‘ক্রসফায়ারে’ দেবে, এটাই ছিল প্ল্যান। বিরোধী দলনেতা বেগম খালেদা জিয়া তাৎণিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ইলিয়াসকে সরকারি সংস্থা নিয়ে গেছে বলে তাকে ফেরত দিতে হবে দাবি তোলায় এবং ২২ এপ্রিল হরতালের ডাক দেয়ায় মতাসীনদের হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এখনো আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন যে তার স্বামীকে জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে। সংবাদ সম্মেলন করে ৩০ এপ্রিল তাহসিনা রুশদী আলী নিবেদন করেছেন : ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে মিনতি করে বলছি, দয়া করে আপনার সাথে দেখা করার জন্য একটু সময় ও সুযোগ দিন। যেকোনো মূল্যে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করে দিন। সংবাদপত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের কথা জানছি। যদি কোনো শর্তও থাকে, তা আমাদের জানানো হোক। যেকোনো শর্তে আমরা তাকে জীবিত অবস্থায় ফিরে পেতে চাই। অর্থ, সম্পদ, মতা কোনো কিছুই আমরা চাই না। ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। তাতে আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই। যদি কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়ে থাকে, তাহলে অন্তত আমাদের জানানো হোক ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন, তিনি কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন। একজন নাগরিক হিসেবে অন্তত এটুকু দাবি করা কোনো অন্যায় চাওয়া নয়।’ প্রধানমন্ত্রী তাহসিনা রুশদী আলীকে সাাৎদান করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন ২ মে সন্ধ্যায়। তাতে গুমট পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি।
আদপে জীবিত বা মৃত ইলিয়াস আলীকে প্রত্যর্পণের দায় ক্রমেই সরাসরি সরকারের ওপর বর্তাচ্ছে, কারণ সন্ধানী সাংবাদিকতা পুলিশের মধ্যেই একজন প্রত্যদর্শীর সন্ধান পেয়েছে। ২৬ এপ্রিল একটি বহুল প্রচারিত সুলভ দৈনিকে সাঈদুর রহমান রিমনের রিপোর্টে প্রকাশ : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণকালে সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তা ধস্তাধস্তির আওয়াজে ঘটনাস্থলে হাজির হন। তিনি ছিনতাইকারী ভেবে অপহরণকারীদের একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন এবং নিয়মমাফিক কৌশলগত হুমকি দিয়ে বলেন, ‘কেউ লড়বে না, গুলি করে দেবো কিন্তু।’ এ সময় ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত একজন মাইক্রোবাসের সাইডে এগিয়ে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজেদের একটি বিশেষ বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি; বাধার সৃষ্টি করবেন না, সরে দাঁড়ান। পুলিশ কর্মকর্তা মাইক্রোবাসের ভেতরে ওই বাহিনীর কিছু নমুনা দেখতে পেয়ে কথিত অভিযান পরিচালনাকারীর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যান। মাইক্রোবাসের লোকটি এবার এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘সরে যেতে বললাম, এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।’ এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা জোর কদমে হেঁটে রাস্তাটির দণি পাশের জলখাবার হোটেলের সামনে রাখা মোটরসাইকেলটি নিয়ে তার কর্মস্থল গুলশান থানায় পৌঁছে যান। তার অফিসার ইনচার্জ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। অফিসার ইনচার্জ বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোনে আলাপ করে ওই সাব-ইন্সপেক্টরকে এ বিষয়ে আর মুখ খুলতে নিষেধ করে দেন। তাকে সাবধানে চলাফেরারও পরামর্শ দেন। প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা তার অফিসার ইনচার্জের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় আরো জানান, তাকে যখন ধমক দিয়ে সরানো হচ্ছিল তখন গাড়ির ভেতর থেকে ধস্তাধস্তি ও ধমকাধমকির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় পাশের একটি ভবনের আড়াল থেকে একজন মোবাইল ফোনে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন। সেখানে মোবাইল স্ক্রিনের আলো তিনি যেমন দেখতে পেয়েছেন, তেমনি অপহরণকারীদেরও একজন খেয়াল করছিলেন। মোবাইলে ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তিকে ওই পুলিশ প্রত্যদর্শী পরে খোঁজ করে কোনো হদিস পাননি। ঘটনার পর পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদপত্রে ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করার বৃত্তান্ত জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ আরেক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘ইলিয়াস আলীর অপহরণ ও গুমের ঘটনায়’ কোনো রকম তথ্যসূত্র-প্রমাণাদি রাখতে চাননি অপহরণকারীরা। এ কারণে তার গাড়িচালককেও জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এভিডেন্স (স্যাপ্রমাণ) হিসেবে ছিলেন শুধু ওই পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রায় সম্পৃক্ত থাকা প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘অপহরণকারীরা’ অবিশ্বাস করেননি। সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা, ইলিয়াস আলীর অপহরণ বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলার পর দ্বিতীয় এভিডেন্স হিসেবে প্রত্যদর্শী কর্মকর্তা নিজের জীবন নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা যে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তার সাবুদ পাওয়া গেছে মহাখালী মোড়ের পেট্রলপাম্পসংলগ্ন জলখাবার হোটেল থেকে। ওই হোটেলের একজন কর্মী জানান, ওই রাতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলযোগে মহাখালীর অদূরে ডিউটি দিচ্ছিলেন। থানায় ফেরার আগে তিনি রাস্তায় মোটরসাইকেলটি থামিয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসেন। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে দু’জন পথচারী এসে জানায়, রাস্তার মধ্যে ছিনতাই আর মারামারি হচ্ছে। এটুকু শুনেই ওই সাব-ইন্সপেক্টর সে দিকে ছুটে যান। তার পেছনে আরো এক-দু’জন এগিয়ে গেলেও তারা অজ্ঞাত আশঙ্কায় নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। 
অন্য দিকে তদন্তের নামে র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতা এখনো চলছে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ইশরায় তথা নিখোঁজ ইলিয়াস বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার কিনা কিংবা ‘বিরোধী দলনেতার নির্দেশে (ইলিয়াস আলী নিজেই) লুকিয়ে আছে কিনা’, তার সম্ভাব্য সূত্র আবিষ্কারে, ইলিয়াস উদ্ধারে নয়। সহজ ভাষায় বলা যায়, বানোয়াট একটা ‘কেস’ সাজানোর জন্য নানা ধরনের আলামত সংগ্রহ হচ্ছে, ইলিয়াসকে খোঁজা হচ্ছে না। মূলত ‘দমনমূলক’ মতলবের কারণে তদন্ত বিভ্রাটের চিত্রটি ফুটে উঠেছে ২৭ এপ্রিল সিলেট থেকে প্রদত্ত একটি খবরে : লন্ডন থেকে ইলিয়াস আলীর সন্ধানদাতাকে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর বিএনপি অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম, যুক্তরাজ্য। অন্য দিকে সরকারবিরোধী কঠোর অবস্থান, টিপাইমুখ বাঁধ ও সীমান্ত ইস্যুতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ইলিয়াস আলী প্রতিপরে দ্বারা ‘গুম’ হয়েছেন বলে একটা প্রচার পুলিশি মহল থেকেই ছড়াচ্ছে। সরকারের তদন্ত দল সিলেট বিএনপিতে সম্ভাব্য ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দল’-এর সন্ধান করছে। বিএনপির একাধিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কয়েকজনকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল ইলিয়াসকে পাওয়া গেছে বলে রাতভর বিভাগজুড়ে ‘খবর’ ছড়িয়ে পড়ে। এ কথা রটে যে, ইলিয়াস আলীকে জীবিত অথবা মৃত মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি এম নাসের রহমানের বাড়িতে নিয়ে এসে তাকে ফাঁসানো হবে। তাতে উত্তেজিত নেতাকর্মীরা নাসের রহমানের বাগানবাড়িতে সারা রাত অবস্থান নিয়ে চার দিকে পাহারা বসায়। এভাবে চলছে তদন্তের দোহাই দিয়ে রটনার ধূম্রজাল রচনা। শ্রীমঙ্গলের ১৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার (সিও) সাংবাদিকদের জেরায় বলেন, ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবির কোনো অভিযান নেই; তবে অন্য কোনো সংস্থা ধলাই সীমান্ত এলাকার চা বাগানে অভিযান চালাতে পারে। মাধবপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ছাদিক আলী বলেন, অভিযানের খবর পেয়ে শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানে শ্রমিকেরা সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। সিলেটে ইলিয়াস আলীর নিজের উপজেলা বিশ্বনাথে বিজিবি মোতায়েন হয়েছে। বিশ্বনাথ থানা ঘেরাও ভাংচুর ও পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর স্থানীয় থানায় বিএনপি-জামায়াতের ১৪ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করা হয়। নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক মো: ইসলাম উদ্দিন বাদি হয়ে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিএনপির আরো তিন হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ নিয়ে শুধু বিশ্বনাথ উপজেলায় ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবির আন্দোলনরত ১৭ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হলো। গ্রেফতার আতঙ্কে বিশ্বনাথের ১৫-১৬ গ্রাম এখনো পুরুষশূন্য। সিলেট নগরীসহ বিভাগের আরো কয়েকটি উপজেলায় সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির আরো কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে ওই সব এলাকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিএনপি নেতা এখন ফেরার, তল্লাশিতে তছনছ হচ্ছে তাদের বাড়িঘর। 
এ দিকে ঢাকায় ২২-২৩-২৪ এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পর ২৯-৩০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা সকাল-সন্ধ্যা জোড়-হরতালের প্রথম দিন নয়াপল্টনে সকাল থেকেই বিএনপির কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে দলীয় কার্যালয়ে আসেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিকেল অবধি দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে কিছু কেন্দ্রীয় নেতা অবস্থান নিতে পারলেও কোনো কর্মীকে ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। পুলিশের আচরণে ােভ প্রকাশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার দেশটাকে কারাগারে পরিণত করেছে। ওই সময় বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে সচিবালয়ের ভেতরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়াল ঘেঁষে ভেতরে-বাইরে দু’টি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়েছে। কেউ হতাহত না হলেও একজন আনসার কর্মকর্তার গাড়ি তিগ্রস্ত হয়েছে। সচিবালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ ঘটনার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেন। আর পুলিশ কর্তৃপ প্রধান হুকুমের আসামি সাব্যস্ত করে ওই ঘটনার জন্য সে সময়ে ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের অবরোধেই আটকে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বিএনপি পরিচালিত জোটের আরো অনেক প্রথম সারির নেতার বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বর্তমান সংসদ সদস্য। দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাসায় বাসায় পুলিশের হানা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল থেকেই বিরোধী জোটের নেতারা ‘আন্দোলনের কৌশলগত প্রয়োজনে’ ফেরার থাকছেন। একজনের আগাম জামিন হয়েছে। অন্যদের কৌঁসুলিরা ছয় দিন ধরে তাদের আগাম জামিনের জন্য চেম্বার জজ থেকে শুরু করে আদালতের বেঞ্চে বেঞ্চে নিষ্ফল ঘুরেছেন। অবশেষে হাইকোর্টের চার দিকে কড়া গোয়েন্দা পুলিশের পাহারা এড়িয়ে যারা আদালতে ঢুকতে পেরেছেন, তাদের নিম্ন আদালতে মামলা না ওঠা পর্যন্ত এক রকম ছাড় দেয়া হয়েছে। হরতালে নিরাপত্তার নামে ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১০ প্লাটুন সদস্য নামানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও ৩০ এপ্রিল হরতাল-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মে দিবসের পরদিন সারা দেশে বিােভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি ও ১৭ সহযোগী দল। পরবর্তী কর্মসপ্তাহে ৬ মে আবারো কঠোরতর কর্মসূচি ঘোষিত হবে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়। সেই কর্মসূচির ঘোষণাও এসেছে। আবারো তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ইলিয়াস আলীর উদ্ধার আর ১৮ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নাশকতার সাজানো মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৯ মে সারা দেশে বিােভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। সরকার সাড়া না দিলে ৯ মে রাজধানীতে সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন থেকে এক দফা তথা সরকার পতনের ডাক আসতে পারে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে।
সচিবালয়ে বোমা হামলার ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামি করার তীব্র সমালোচনা করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, ‘সচিবালয়ে নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে কিভাবে বোমা হামলা হলো? আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ এটি ঘটিয়ে নাটক করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এই নাটক করছেন। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দিন, নাটক করবেন না। নাটক করে মতায় টিকে থাকতে পারবেন না।’ তাকে ব্যঙ্গ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, এক মামলাতেই বিএনপির সব আন্দোলন চুপসে গেছে! 
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, গুম কালচার, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যার প্রশ্নে সরকারের জবাব চেয়ে মার্কিন মহলসহ বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন মুখপাত্র উদ্বেগ ব্যক্ত করে চলেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্বেগতাড়িত হয়ে বৈদেশিক কংগ্রেসম্যান সিনেটর এমপি মন্ত্রী বা দূতাবাস মুখপাত্র বাংলাদেশে হাল আমলের গুম-লাশের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই কঠোর ভাষায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সম্ভবত তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক সংলাপ ও সৌজন্যের বেষ্টনী অতিক্রম করবে না। কিন্তু বিশ্ববিবেকের কাছে আর্জি পেশ করে অনলাইনে এবং মানবাধিকারের প্রহরী বিশ্ব সংস্থাগুলোতে যে ধিক্কারের আওয়াজ উঠেছে, তার বজ্রনিনাদ সহজে নিরস্ত হওয়ার নয়। বাংলাদেশে একের পর এক বিরোধী নেতাকর্মী নিখোঁজ ও গুম হওয়ার ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপে তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ২৭ এপ্রিল প্রচারিত তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয় (সারসংপে) : ‘বিনা কারণে বাংলাদেশের বিরোধী নেতাকর্মীরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের কোনো হদিস না পাওয়ার মতো ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ নিখোঁজ সব নেতাকর্মীকে খুঁজে বের করতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। হাসিনা সরকার বারবার দেশে অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশটিতে গুম, খুন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এবং রহস্যজনক নিখোঁজের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনার স্বাধীন ও নিরপে তদন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।’
এর আগে গত ৪ এপ্রিল শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনায়ও (পরে তার তবিত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়) উদ্বেগ জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বিরোধী দলের হরতালের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অত্যধিক শক্তিপ্রয়োগের’ ঘটনাতেও উদ্বোগ প্রকাশ করেছে এবং ২১ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে দু’জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওই সংস্থা। সরকার নির্বিকার। সর্বশেষ ৫-৬ মে ঢাকা সফর করে গেছেন একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিলারি কিনটন। হরতালের চক্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ‘হিলারি-বিরতি’ দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বাংলাদেশ-মার্কিন বৈঠকি আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে হিলারি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়া ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। এ ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্তের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি।’ হিলারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলনেতা খালেদা জিয়া উভয়ের সাথে সাাৎ করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করার তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকার পরে সংলাপ প্রস্তুতির কোনো লণ নেই।
বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মী ধরপাকড় করেই আন্দোলন ঠাণ্ডা করা যাবে ভাবছে মতাসীনরা। কিন্তু মিসরের তাহরির স্কোয়ারের মতো ঢাকার বুকে গরহাজির নেতৃত্বের অস্ফুট কণ্ঠের ডাক শুনতে না পেয়েও যে জনরোষ অত্যাচারী আত্মসেবী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে পারে, এ কথা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট