॥ সাদেক খান ॥
গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন