মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

ঘনায়মান রাজনৈতিক সঙ্কটের বিস্ফোরণমুখী যাত্রা

ঘনায়মান রাজনৈতিক সঙ্কটের বিস্ফোরণমুখী যাত্রা

বিচিন্তা

॥ সাদেক খান ॥

দেশের ঘনায়মান রাজনৈতিক সঙ্কটের ভয়াবহতা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা, টেলিসংলাপ আর পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলছে বেশ কিছু দিন ধরে। এই রাজনৈতিক সঙ্কটের ঘোর এখনো মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক। এ দেশের উন্নয়ন সহযোগী বৈদেশিক কূটনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই এ দেশের প্রবৃদ্ধির অন্যতম বাধা হিসেবে শনাক্ত করেছেন। একধাপ এগিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত একজন ভ্রাম্যমাণ লোকসেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ দেশের বিভিন্ন শহর বা মার্কিন সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্প দর্শন ও বিভিন্ন বৈঠকি অনুষ্ঠান বা সংবর্ধনা সভায় তিনি বারবার একটা সুষ্ঠু, নিরপে ও সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ল্েয নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও তদারকি প্রশাসন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদলীয় প্রধান দুই রাজনৈতিক পরে মধ্যে ‘এই বছরের মধ্যে’ সমঝোতা হওয়া অতি জরুরি বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেনÑ অন্যথায় গণতন্ত্র বিপন্ন হতে পারে, তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয় হতে পারে এমন ইঙ্গিত করেছেন।
প্রায় একই কায়দায় টকশোতে এ দেশের নীতিবোধলুপ্ত সংঘর্ষপ্রবণ দোষারোপের রাজনীতি তৃতীয় শক্তির উত্থানের ইন্ধন জোগাচ্ছেÑ প্রকারান্তরে এমন কথা বলে উচ্চ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন সুশীলসমাজের চাঁই একজন বিশিষ্ট অধ্যাপক। ওই ধরনের বক্তব্যের জন্য (অভিযোগকারী তার কৌঁসুলি) (সামরিক) অভ্যুত্থানের উসকানি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশ, উচ্চ আদালতের সমন পেয়ে অধ্যাপক সাহেব হাজির হলে কাঠগড়ায় তাকে সোয়া ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তার পদমর্যাদা বিবেচনা করে বসার সুযোগ দেয়ার জন্য তার কৌঁসুলি অনুরোধ করলে আদালত বলেনÑ সচিবদেরও ওই রকম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়; আইনের চোখে সবাই সমান।
অতীতে একজন বয়োবৃদ্ধ চিন্তাবিদ সাবেক সচিবকে একইভাবে কাঠগড়ায় সারা দিন দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন এই আদালত। তার অপরাধ ছিল টকশোতে উচ্চ আদালতের প্রতি কটা করে বক্তব্য দিয়ে লোকচে আদালতের মর্যাদাহানি। নিষ্কৃতি পেতে কৌঁসুলির পরামর্শে ওই ‘মুরব্বি’ সাবেক সচিব আদালতের কাছে মা প্রার্থনা করে অপরাধের দায় স্বীকার করেছিলেন। বলা যেতে পারে আদালত তাকে লম্বা লেকচার দিয়ে তিরস্কার করে এবং সারা দিন দাঁড় করিয়ে রেখে অভিযুক্তের স্বীকৃত অপরাধের লঘুদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্মানিত অধ্যাপকের েেত্র তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আমলযোগ্য কি না সে বিষয়ে শুনানির পর্যায়েই তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। এটা অপরাধ প্রমাণের আগেই শাস্তিদান হলো বলে কথা উঠেছে মানবাধিকারের বিলাসিতা চর্চাকারী মহলে। তারা আরো বলছেন, আদালতের এমন নিয়ম এ দেশে ঔপনিবেশিক আমলের প্রশাসক বা বিচারকদের রাজকীয় মর্যাদার উত্তরাধিকার, যেটা গণপ্রজাতন্ত্রে নাগরিকের মানহানিকর। আমরা যুক্তরাজ্যের রানীকে আর সম্রাজ্ঞী বলে মানি না, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর পোশাকি প্রধান হিসেবেই মাত্র তাকে সম্মান করি। এ দেশের বিচারক কিংবা সচিব রাজপ্রতিনিধি নন, গণপ্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম মতার অর্পিত এখতিয়ারের প্রতিনিধি। প্রজার মর্যাদাহানির ঔপনিবেশিক অভ্যাস যারা ছাড়তে পারছেন না, তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-স্বীকৃত জনগণের সার্বভৌম মতা ও মৌলিক অধিকারের মর্মবাণীকে উপো করছেন।
যুক্তরাজ্য এখনো রাজতন্ত্রের নানা মানব মর্যাদাহানিকর রেওয়াজ পোশাকিভাবে চালু রেখেছে যে জন্য রাজদণ্ডের প্রতিভূর সামনে একরকম মাথা নিচু করে চলতে সে দেশ অভ্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আদালত আসামিকে নির্দোষ বলেই গণ্য করে; শুনানির সময় অভিযুক্ত বসেই অভিযোগকারী বা সাীর বক্তব্য শোনেন। জামিনের অযোগ্য গুরুতর অপরাধের আসামিকেও কাঠগড়ায় বসতে দেয়া হয়।
সুশীলসমাজে মানবাধিকারের প্রবক্তা মহলে আরো কথা উঠেছে, প্রফেসর সাহেবকে দাঁড় করিয়ে রাখার যৌক্তিকতা হিসেবে সচিবকে দাঁড় করিয়ে রাখার নজির উত্থাপন করেছেন আদালত। তারপর বলেছেন, আইনের চোখে সবাই সমান। মানবাধিকার প্রবক্তা বলছেন, সচিবকে দাঁড় করিয়ে রাখার নজির তুলে আদালত আসামিদের মর্যাদার তারতম্য সম্পর্কে তার সুপ্ত চেতনাকেই প্রকাশ করেছেন। রাজমতার প্রতিভূ সচিবকেও আদালত দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এমন উচ্চমতার অহঙ্কারের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অন্য দিকে গণতন্ত্র কেন সমকালীন রাজতন্ত্র, শেখতন্ত্র কিংবা আফ্রো এশীয় স্বৈরতন্ত্রের অবশিষ্ট দেশগুলোতেও খুনের আসামি আর বিবেকের আসামিকে এক করে দেখা হয় না। মুক্তচিন্তার অধিকার বা বিকারের কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনের অযোগ্য অপরাধের আসামির সাথে এক করে দেখলে সুবিচার দূরের কথা, নৈয়ায়িক মানব সভ্যতার যে মূলমন্ত্র বাছবিচার বা ডিফারেনসিয়েশন তার বরখেলাফ হয়; মুড়িমুড়কির একদর সাব্যস্ত করা হয়। 
সুশীলসমাজের অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সঙ্কটের আবর্তে এক দিকে সুশীলসমাজে বিবেকের ভাষা ক্রমেই প্রখর ও সরব হয়ে উঠেছে, অন্য দিকে জনসমাজেও তেমনি বিদ্রোহী চেতনার উন্মেষ ঘটাচ্ছে। তারই একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পদত্যাগী রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিবের গাড়িচালক আলী আজমের বিবেকতাড়িত পদপে। রেলের নিয়োগবাণিজ্যের মোটা টাকা বহন করে প্রায় মধ্যরাতে তিন কর্মকর্তাসহ মন্ত্রীর বাড়িতে যেতে অস্বীকার করায় আর গাড়িতে (কালো) টাকা আছে বলে চেঁচামেচি শুরু করায় পিলখানায় বিজিবির কাছে জব্দ হয়ে উদঘাটিত হলো ওই নিয়োগবাণিজ্যের কেলেঙ্কারি। বিজিবি সকালে টাকাসহ সবাইকে ছেড়ে দিলেও তখনই আলী আজম ছাড়া পাননি, কালো টাকার কাঁড়ি নিয়ে রেল কর্মকর্তারা ও মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব তাদের মর্জিমাফিক যথাস্থানে পৌঁছার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু মিডিয়ায় এবং সরকারি ও বিরোধী উভয় রাজনৈতিক মহলে বমাল (নগদ টাকা) হাতেনাতে ধরা পড়া রেল মন্ত্রণালয়ে নিয়োগবাণিজ্যের আলামত যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে তার জেরে রেলের দুই কর্মকর্তা তদন্তসাপেে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং তার ও তার স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। খোদ রেলমন্ত্রীও নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে রেলের মন্ত্রণালয়ে নিয়োগবাণিজ্যের উদঘাটিত কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করে বেঁচেছেন।
কিন্তু আলী আজমের হদিস নেই, চার দিকে গুজব আর আশঙ্কার ছড়াছড়ি। একপ বলছে, আলী আজম এত সাহস পেলেন কোত্থেকে? তাকে অভয় দিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে উসকে দিয়েছে 
‘চক্রান্তকারী’ একটি মহল; ওই মহলই তাকে আড়াল করে ‘নিরাপদ হেফাজতে’ রেখেছে। অন্য মহল বলছে, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ধরা পড়া রেল কর্মকর্তা ও তাদের রাজনৈতিক মুরব্বিরা চুক্তিখুনি নিয়োগ করে আলী আজমকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে তার লাশ গুম করেছেÑ যাতে সে কোনো রকম স্যা দিতে না পারে আর সরকারের মধ্যে বিদ্রোহীভাবাপন্ন কর্মচারীরাও যাতে প্রাণের ভয়ে মতাসীনদের বাধ্য থাকেন।
এসব জল্পনার জটিলতা আমলে না নিয়ে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া সংবাদপত্রে প্রকাশিত, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, বলতে হয় বিভিন্ন পত্রিকার পাঠক প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই অনলাইনে আলী আজমকে দেশের রাজনৈতিক রূপান্তরের চাহিদার ঘোষক ও প্রতিবাদের রথযাত্রার অগ্রনায়ক হিসেবে শনাক্ত করেছেন। ওই গাড়িচালকের পরিবার, গ্রাম্য পড়শি ও শিানবিশী জীবনের পরিচিতদের প্রতিক্রিয়া পত্রিকান্তরে লিপিবদ্ধ করেছেন দু’জন প্রতিবেদক আলম পলাশ ও মুহাম্মদ জাকির হোসেন (মতলব, চাঁদপুর থেকে)। তাদের আংশিকভাবে উদ্ধৃত করছিÑ “আলী আজমের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দণি উপজেলার উত্তর উপাদী ইউনিয়নের উত্তর নওগাঁও গ্রামে। গতকাল দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সম্পদ বলতে তেমন কিছুই নেই। পৈতৃক দু’টি ছোট ঘর এবং কিছু কৃষিজমি। দু’টি ঘরে তার বাবা-মা ও ভাইয়েরা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আলী আজম চতুর্থ।”
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আলী আজম স্থানীয় নওগাঁও উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব চালাতেন। পরে এপিএস ওমর ফারুকের গাড়ি চালানোর চাকরি নেন। বিয়ে করেন পাশের মৃধাবাড়ির আবুল খায়েরের মেয়ে স্বপ্নাকে। তাদের ৯ মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে।
আলী আজমের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক দুদ মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে অবৈধ টেয়া ধরাইয়া দিয়া কী দোষ করছে জানি না। দোষ করলে ওর বিচার হোক। কিন্তু ঘটনার পরের দিন থেইক্কাই সে নিখোঁজ। সে কি পিলখানায় আছে, নাকি অন্য কোথাও আছে জানি না। ঘটনার পর থেইক্কা আমাগো পরিবারতন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এমনকি তার স্ত্রীর সাথে ফোনেও যোগাযোগ নাই। হুনলাম রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করছে। বাহি তিনজনেরও শাস্তি অইছে। সবারই খোঁজখবর আছে, কেবল আমাগো পোলাডারই খোঁজ নাই। সে কি বাঁইচা আছে, নাকি মইরা গেছে; নাকি কেউ তারে মাইরালাইছে, তা-ও জানি না। সরকারের কাছে আমাগো প্রশ্নÑ আমাগো পোলা এহন কোথায়? ওরে আমাগো কাছে ফিরাইয়া দেন।’ 
আলী আজমের ঢাকার বাসা, আত্মীয়স্বজনের বাসাসহ অনেক জায়গায় খুঁজেও তাঁকে পাননি বড় ভাই আবদুল কাইয়ুম খান। তিনি বলেন, ‘তাইলে কি আমার ভাই হাওয়া হইয়া গেল?’
চাচা ইউপি সদস্য বিল্লাল হোসেন খান বলেন, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী আলী আজমের বিষয়টি পরিষ্কার করে না কেন?
উত্তর নওগাঁও গ্রামের রিকশাচালক কবির হোসেন বেপারি, মুদিদোকানি ওয়াসিম মিয়া, বেকার যুবক লিটন সরকার ও কৃষক খোকন দেওয়ানের ভাষ্য মতে, আলী আজম সৎ, চরিত্রবান, ধার্মিক; সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ। অবৈধ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তিনি দেশপ্রেমিকের কাজ করেছেন। তবে আলী আজমের সন্ধান না পাওয়ায় তার জীবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।
প্রতিবেশী ছালেহা বেগম বলেন, ‘আলী আজম খুব ভালা একটা পোলা। হুনতাম সে খুবই অভাবে থাকত। মাঝে মাঝে বাড়িতে আইয়া বাসার লইগগা চাইল-ডাইল লইয়া যাইত। দোয়া করি, সে বাঁইচ্চা থাউক।’
গ্রামের অন্যরাও বলেনÑ ‘ছোডকাল থেইক্কাই আলী আজম নিরীহ। তার কিছু খারাপ দেখি নাই।’
ওই প্রতিবেদন পড়ে সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা ও বিবেকের তাড়না দেখে আমার এ কথাই মনে হয়েছে, অনলাইনে বিবেকতাড়িত তরুণ আরব সমাজের ােভ প্রকাশ থেকেই প্রথমে একটু একটু করে দ্রুত দানা বেঁধে প্রস্ফুটিত হয়েছিল মিসরের তাহরির স্কোয়ারের আরব বসন্তের লাখ লাখ কুঁড়ির বিস্ফোরণ। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন