মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

রক যখন ভক হয়

রক যখন ভক হয়



॥ সাদেক খান ॥

সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত ৫২,০৬৮ কোটি টাকার ঘাটতিসহ ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকার বিশাল বাজেট এখন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন টকশো আর নব্য ধনী গৃহে অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আরো আলোচ্য, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ‘বাড়াবাড়ি’ কিভাবে ধরপাকড় করে, জেলে পুরে, পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, মামলা-হামলায় শায়েস্তা করা হচ্ছে। প্রথমোক্ত বিষয়ে সরকার বাহাদুরের তরফে অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা : বাজেট মোটেও বিশাল নয়, ঘাটতিও তত বেশি নয়। লুকানো কালো টাকা সাফ করে জাহির করার যে ঢালাও সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে তার সাফাই : ‘কালো টাকাকে আমি কালো বলি না, বলি অপ্রদর্শিত আয়। এ টাকা অবশ্যই বিনিয়োগের মধ্যে আনতে হবে।’ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৮ থেকে ৮২ শতাংশ এখন অপ্রদর্শিত আয়। পরপর তিনটি বাজেটে ধারাবাহিক শেয়ার কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংকিং ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় নানা ধাঁচের ফন্দিফিকির ‘রিশবৎ’ আদায়ের সুযোগ করে দিয়ে হাস্যমুখ অর্থমন্ত্রী রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। কালো টাকার কুমিরদের সংখ্যায় ও টাকার ওজনে তিনিই প্রশ্রয় দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দৈত্য বানিয়ে ফেলেছেন। আর তারা যে জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৮২ ভাগ পর্যন্ত দখল করে এখন চেপে বসেছে, এ কথা বলতে একটুও লজ্জাবোধ করলেন না বেশরম অর্থমন্ত্রী।
এখানেই মো দেননি পোবাবু অর্থমন্ত্রী। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণফোনের বদৌলতে গ্রামেগঞ্জে মোবাইল ফোন চালু হয়ে সস্তা চীনা মুঠোফোন কিনতে পেরে দেশের আনাচে-কানাচে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে গরিবের জন্য। মুঠোফোনে লেনদেন হয়, কেনাবেচা হয়, দূরালাপনি স্বাস্থ্যসেবা হয়, সুখে-দুঃখে প্রবাসী রোজগেরে স্বামী-পুত্র-কন্যার সাথে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামেগঞ্জে দুই-চারটে মুঠোফোন দিয়েই হাজারো পরিবারের সেবা হয়। প্রত্যন্ত এলাকায় সাইকেলে ঘুরে ঘুরে কিংবা দোকানে বসে দরিদ্র মুঠোফোনকর্মী সেবা বিতরণ করেন। শুধু অসমর্থ, বৃদ্ধ বা বিপন্ন ব্যক্তির জন্য নয়, কর্মব্যস্ত েেতর কৃষক, সেলাইঘরের দর্জি, মাছের বাজারের জেলে, নৌকার মাঝি, ঘাটের মুটে, বাড়ির বউ, ছেলেমেয়ের মা, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, দিন-আনা দিন-খাওয়া সংসারের হাড়ভাঙা খাটুনিতে যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেসব মেহনতি মানুষের দোরের কাছে বরকত হয়ে পৌঁছেছে মুঠোফোনসেবা। এখন খামখেয়ালি অর্থমন্ত্রী হুকুম জারি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, যাতে একজন মুঠোফোন ব্যবহারকারী ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সাথে সাথে দুই টাকা কর হিসেবে কেটে রাখা হবে। করলেন খরচ, হয়ে গেল আয়। এমন আয়কর বসানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী যে, মুঠোফোনে কথা বললেই কর দিতে হবে। আমরা এর আগে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বা ঠিকাদারি ব্যবসায়ে মাল ছাড় বা বিল ছাড়ের সময় সম্ভাব্য মুনাফার শতাংশ হিসাব করে অগ্রিম ‘উৎসে কর’ কেটে রাখার ব্যবস্থা দেখেছি। করদাতা মুনাফা কম হয়েছে বা লোকসান হয়েছে দেখাতে পারলে বছর শেষে পুরো ব্যবসার আয়কর থেকে তার রেয়াত বা উৎসে কর ফেরতেরও বিধান রয়েছে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের জন্য ওই আয়কর ব্যবস্থায়। এখন স্বল্পবিত্ত বা বিত্তহীন মেহনতি মানুষের সামান্য আয়ের ওপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের বোঝা তো আছেই, মোবাইল ফোনে কথা বলাকেও গরিবের ঘোড়ারোগ সাব্যস্ত করে ‘ব্যয়ের ওপর আয়কর’ বসিয়েছেন জালেম সরকারের জ্ঞানপাপী অর্থমন্ত্রী। মহাজোটের তল্পিবাহক বামরাজনীতিবিদেরা অর্থমন্ত্রীর কাছের লোক। তারাও বলতে বাধ্য হয়েছেন, এই বাজেটে কেবল ধনী ও লুটপাটকারীদের স্বার্থ রা করা হয়েছে; কালো টাকার মালিক ও লুটেরা ধনীদের স্বার্থ রাকারী এই বাজেট তারা মানেন না। তাদের মুখে এটুকু যে বিষ নেই সাপের কুলোপানা চক্কোর, তাও ভালো। জবরদস্তি চাঁদাবাজি, ছিনতাই আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপে কুলোপানা পিঠ পাবলিকের সেই মাজার জোরটুকুও নেই। অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব নির্বাচনী এলাকারই একজন রসুন বিক্রেতার ীণ প্রতিবাদের ভাষা : ‘বাজেট ঘোষণা অইলেই কিতা (হলেই কি), না অইলেই কিতা। আমরার মতো মানুষের চলিয়া খাওয়ার কোনো প্রসেস (উপায়) নাই। বাজেট অইলে সবগুলা জিনিসের রেইট (দাম) বাড়ে। কোনো দিন বাজেট অইছে, আর জিনিসের দাম কমছে, এটা দেখি নাই।’
অঢেল কালো টাকার মালিক ছাড়া ধনী ব্যবসায়ীরাও খুশি নন ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। শিল্প বাণিজ্য চেম্বার ও সমিতিগুলোর শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদের ভাষায় : বাজেট বরাদ্দের জন্য সরকারের চাহিদা মিটাতে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার যে আভাস দেয়া হয়েছে, তাতে বেসরকারি খাত নানামুখী সমস্যায় পড়বে। সরকার ব্যাংক থেকে বেশি হারে ঋণ নিলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে না এবং পুঁজি সঙ্কটে পড়বে। ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার আরো বেড়ে যাবে।
অর্থমন্ত্রীর মতো সাবেক ‘সিএসপি’ মর্যাদার আর্থিক প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা কিংবা তারই মতো বিশ্বব্যাংকে চাকরি-ফেরতা সামষ্টিক অর্থবিদ্যায় চৌকস ব্যক্তিরা অথবা অর্থমন্ত্রীর হিতৈষী বাজেট বিশ্লেষণপটু থিঙ্কট্যাঙ্ক তথা মাথাওয়ালা পঞ্চক প্রায় কেউই অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় সম্মত হতে পারছেন না। বলছেন, সাধ্যের মাপকাঠিতে এটা আদপেই বিশাল বাজেট, ব্যাকরণসিদ্ধ (কেউ কেউ বলছেন ব্যাকরণসর্বস্ব), কিন্তু বাস্তবসম্মত নয় (কেউ কেউ বলছেন একেবারেই লোক দেখানো বাজেট; নির্বাচনী প্রচারের জন্য, বাস্তবায়নের জন্য নয়)। বাজেট ঘাটতিও যতটা দেখানো হয়েছে, দাঁড়াবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর রাজস্ব সংগ্রহের রেকর্ড বলে দেয়, প্রাক্কলিত রাজস্বের ল্যমাত্রা পূরণ হবে না। এ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর বৈদেশিক সহায়তা সদ্ব্যবহারের বা ছাড় পাওয়ার অমতার রেকর্ড বলে দেয়, বৈদেশিক সাহায্যের যে অঙ্ক দেখানো হয়েছে সেটাও ঘরে আসবে না, কাগজে-কলমেই লেখা থাকবে।
যদি নির্বাচনী প্রচারে কৃতিত্বের ফর্দ বাড়ানোর তাগিদে সুশাসনে ব্যর্থ স্বেচ্ছাচারী আত্মসেবী গণবিমুখ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আদপেই বাজেট বাস্তবায়নের এরাদা থাকে, তবে দেখা যাবে রাজস্বের কমতি প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যে কমতির এবং শূন্য পূরণ করতে দেশের ব্যাংকগুলো থেকেই সরকারকে আরো ধার করতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য সঙ্কট ডলার সঙ্কট আরো বাড়বে। কালো টাকার মালিকরা বিদেশে জমানো ডলারের গোপন পুঁজি বিনা জিজ্ঞাসায় দেশে নিয়ে এসে নতুন লাইসেন্স পাওয়া আওয়ামী ব্যাংকগুলোকে চাঙা করবে, এমন যে আশার কথা অর্থমন্ত্রী বড় গলায় বলে চলেছেন, সেই আশাবাদের মুখেও ছাই পড়বে যদি না রাজনৈতিক সঙ্ঘাত আর অপরাধবৃত্তের প্রতাপ রোধ না করা হয়। 
সুশীল সমাজের মুরব্বিদের তরফে এমন হুঁশিয়ারির জের ধরে এবার দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয়ের কথায় আসা যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশের আগের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২২০৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে সমাবেশকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৫০ জনকে। বরিশাল থেকে লঞ্চ এবং বগুড়া থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। দণিাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলোতে যাত্রীবোঝাই করে যেতে দিয়ে ঢাকায় ফিরতে নিষেধ করা হয়। কয়েকটি জেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বহন করা গাড়ি আটকে দেয়া হয়। কোথাও কোথাও ভাড়া করা গাড়িগুলোর ভাড়াচুক্তি বাতিল করতে বাধ্য করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অহেতুক তল্লাশির নামে হয়রানি এবং ঢাকা অভিমুখে বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চলে। ঢাকার বাইরের আগন্তুকদের হোটেলের কামরা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে এক ত্রাসের ডামাডোল সৃষ্টি করেছে সরকারেরই পুলিশ বাহিনী। সমাবেশের দিন ১১ জুন সকাল থেকেই রাজ্যের পুলিশ রাস্তায় নামিয়ে ঢাকার প্রবেশমুখ গাজীপুরের চন্দ্রা, সদরঘাট, বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ করে দিয়ে ঢাকামুখী মানুষের গতিরোধ করা হয়। রাজধানী শহরের ভেতরে গণপরিবহন চলাচল কমে যায় বা বন্ধ রাখা হয়। যানজটের শহর ঢাকায় হরতালের অবস্থা সৃষ্টি হয়।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। অফিসগামী ও অফিসফেরত মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। ব্যস্ত ভিআইপি সড়কে চলেছে রিকশা ও রিকশাভ্যান। অনেককে ভেঙে ভেঙে এসব যানে গন্তব্যে পৌঁছাতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। অল্প কিছু বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব চলেছে। পুলিশ হয়রানির ভয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচলও ছিল সীমিত।
যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ুব্ধ মানুষ সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়ে মহাসড়কে দু’টি বাস ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে সরকারসমর্থক পরিবহন শ্রমিকেরা। আটকা পড়া যানবাহনে কাগজপত্র পরীার নামে হয়রানি চলে। সারা দিন উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো বাস ঢাকায় আসতে পারেনি। কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ থেকে খোলামোড়া পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর শতাধিক খেয়াঘাটের নৌকা চলাচলে বাধা দেয় শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীরা। বাধা উপো করে যারা নৌকা নিয়ে বের হয়েছিল, তাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে লাঠিপেটা করে শ্রমিক লীগের কর্মীরা। সদরঘাটে অনেক লঞ্চও ভিড়তে পারেনি। তল্লাশি পুলিশ ‘তুই বিএনপি, তুই বিএনপি’ বলে শুধু বাস নয়, মোটরসাইকেল আর মোটররিকশা থেকেও লোক নামিয়েছে। যাকে ধরেছে তার মানিব্যাগ, দামি জিনিস কিছু সাথে থাকলে কেড়ে নিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে বলেছে। কাউকে কাউকে চড়চাপট দিয়ে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ১৮-দলীয় বিরোধী জোটের ৩০ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ঢালাও দাঙ্গা-মামলায় হুকুমের আসামি হিসেবে অনেকে দুই সপ্তাহের বেশি জেলে আটক। হাইকোর্টে তাদের জামিন হলেও ইতোমধ্যে অন্য মামলা ঠোকা হয়েছে, সে মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট বা নিম্ন আদালতে হাজির করানোর আদেশ জারি করে তাদের অনেককে জেলেই পুলিশ হেফাজতে আটকে রাখা হয়েছে।
তবু ধরপাকড়, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ১৮-দলীয় মহাসমাবেশ হয়েছে। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে মঞ্চ করে আশপাশের রাস্তাজুড়ে প্রায় অর্ধদিবস ধরেই সভা চলেছে। গণসমাবেশ থেকে সংসদীয় বিরোধী দলনেতা বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে তার দেয়া চরমপত্র বা আলটিমেটাম ১০ জুন তামাদি হওয়ার পর সেই চরমপত্রের মেয়াদ আরো বাড়িয়ে ঈদ পর্যন্ত সরকারকে সময়-সুযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রমজানের আগে কঠোর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা না করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে ঈদুল ফিতরের পর হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘটের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। আলোচনার অবকাশ বিস্তৃততর করে বলেছেন, “আলোচনার মাধ্যমে ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন। আশা করি, সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। দাবি আদায় না হলে আন্দোলন ক্রমান্বয়ে জোরদার হবে। আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য করতে আরো বিস্তৃত করা হবে।” চলতি পর্যায়ে ১১ জুনের গণসমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া পাঁচ দিন দেশব্যাপী বিােভ সমাবেশের ঘোষণা দেন। ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে আছে : নির্দলীয়-নিরপে সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় আটক রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ১৭ জুন সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় বিােভ সমাবেশ। জনগণের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো, কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস, রফতানি পণ্যের উৎসে কর বৃদ্ধি, ঋণনির্ভর ও গণবিরোধী বাজেটের বিরুদ্ধে ২৪ জুন, ইলিয়াস আলীসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মী-ব্যবসায়ী অপহরণ, সাংবাদিক সাগর-রুনি ও কূটনৈতিক হত্যা এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা, নারী-শিশু নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে ১ জুলাই, সন্ত্রাস-দুর্নীতি, দুঃশাসন, বিদ্যুৎ-পানির সমস্যা, অসহনীয় যানজটের প্রতিবাদে ৮ জুলাই এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৫ জুলাই সব মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় সমাবেশ ও বিােভ মিছিল। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৫ জুলাইয়ের কর্মসূচি থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেয়া হবে। তবে প্রয়োজনে ঈদের আগে কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও ঘোষণা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধা দেয়া বন্ধ করুন। নইলে এর দায় আপনাদের বহন করতে হবে।’
সরকারের পুলিশি বাধা খাড়া করার সাফাই গেয়ে মতাসীনদের পে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। প্রকারান্তরে বলেছেন, ওই ওষুধে কাজ হয়েছে। বলেছেন, “বাস্তবতা উপলব্ধি করে বিরোধী দলনেতা রণেভঙ্গ দিয়ে ‘কঠোর কর্মসূচি’ থেকে সরে এসেছেন।” সাধারণ পাবলিক বলছে : মানুষকে যেভাবে দ্রব্যমূল্যের কষ্টের ওপর পুলিশি জুলুমের কষ্ট দিয়ে সরকারের ওপর পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছেন তারা, সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন কি মতাসীন দলের নেতারা? বিরোধী দল বিএনপি সমাবেশ করে, আর সেজন্য পুলিশ পিকেট দিয়ে ঢাকা অবরোধ করে বাসযাত্রী, মোটর, রিকশা যাত্রীকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে মারধর করে হরতালের দুর্ভোগ ভোগায় খোদ সরকার। এ কোন মগের মুল্লুকে বাস করছি আমরা? রক যখন ভক হয় তখন নিরীহ গরিব মানুষ দুর্গতি ছাড়া আর কী আশা করতে পারে? 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন



॥ সাদেক খান ॥

গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ 
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন

গরিবের মালিকানা রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতার আবেদন



॥ সাদেক খান ॥

গত ৩১ মে এ দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিশদ বিবৃতির মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যুক্তভাবে নোবেল বিজয়ী কৃতীপুরুষ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারি হস্তেেপর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ বিপন্ন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সরকার এর আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকারি ব্যাংক প্রধানের বয়ঃসীমার খোঁড়া অজুহাতে (গ্রামীণ ব্যাংকসংক্রান্ত বিশেষ আইনে এমন কোন বয়ঃসীমার বিধান নেই) অধ্যাপক ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারের যথার্থ জরদ্গব অর্থমন্ত্রী গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ (তথা অধ্যাপক ইউনূসের) উদ্যোগে গঠিত সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের খবরদারি আর সাংগঠনিক পরিবর্তনের সুপারিশের মতা দিয়ে একটি আমলাতান্ত্রিক ‘তদন্ত কমিশন’ গঠন করেছেন। বাংলা ভাষায় লিখিত ১৫ মে ওই গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে ১৯৫৬ সালের ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইনের আওতায় গঠিত কমিশনের কার্যপরিধি বা ‘টার্মস অব রেফারেন্স’ দেয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। ৬ উপধারাসহ সাত ধারা সংবলিত ওই কার্যপরিধিতে এ কথা স্পষ্ট যে, কমিশনের অন্যতম ল্য হবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেসরকারি (ঋণগ্রহীতা ও দরিদ্র সঞ্চয়ীদের) মালিকানা বাতিল করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের উপায় উদ্ভাবন। কমিশনকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নাজেহাল করতে তিন মাসের মধ্যে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন ২৭ বছরের কার্যক্রম ‘পর্যালোচনা’ তথা কার্যত পোকাবাছা (তিন মাসে এত বড় প্রতিষ্ঠানের সাতাশ বছরের কাগজ ঘাঁটা যে অসম্ভব সেটা বলা বাহুল্য)। তা ছাড়া ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে পরিচালিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলো (যার সবগুলোই ‘গ্রামীণ’ এই নামে মাত্র গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সম্পর্কিত, আইনত অধিকাংশ কোম্পানি আইনের আওতায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের সীমিত গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত) সম্পর্কে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেগুলোর ‘উত্তরাধিকার বিধিমালা’ (যা আইনেই আছে) নতুন করে প্রণয়নের পরামর্শদানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওই কমিশনকে। যারা অনুরূপভাবে নিবন্ধিত কোনো সামাজিক কাবের সদস্য, তারা ভাবছেন ডিভিডেন্ডের মুনাফাবিহীন কাব সদস্যপদগুলোর বাণিজ্যকরণ করে যেমন বিভিন্ন ফায়দা ভোগ করার বা মর্যাদার লালসায় আজকাল মোটা টাকার ‘হিসাববহির্ভূত’ লেনদেনে কাব সদস্যপদ বিক্রির ব্যবস্থা হয়েছে, স্বল্পবিত্তের সেবায় নিয়োজিত গ্রামীণ কোম্পানিগুলোরও সেভাবে ‘সদস্যপদ’ বিক্রির ফন্দি করছে আওয়ামী লুটেরারা। কিংবা অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যরা গ্যারান্টির ভিত্তিতে নিবন্ধিত কোম্পানির দায়দেনা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আরেকটি অলাভজনক কোম্পানি বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছে মাত্র হস্তান্তর করতে পারে, আওয়ামী সদস্য নিয়ন্ত্রিত তেমন কোনো নয়া ‘অলাভজনক’ কাবের কাছে গ্রামীণ কোম্পানিগুলো হস্তান্তরের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের বাধ্য করার ফিকির খুঁজছেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। সে জন্যই ওই তদন্ত কমিশন।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন : ‘আপনি রাজনৈতিকভাবে যে দলেরই হোন, পেশাগতভাবে যে পেশারই হোন, যে বয়সীই হোন, যেকোনো অবস্থাতেই থাকুন, আমরা একযোগে সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকাঠামো পরিবর্তন করা মোটেই সঠিক কাজ হবে না।’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন : ‘নোবেল পুরস্কারের ১১০ বছরের ইতিহাসে মোট ২০টি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এশিয়ার একমাত্র নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর তদন্ত কমিশন বসিয়ে’ সরকার স্বদেশেরই ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। প্রশ্ন রেখেছেন : ‘সৃজনশীল যে কর্মপদ্ধতি এবং নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সৃষ্টি করে গ্রামীণ ব্যাংক গরিবের কল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি পেল; সে কর্মপদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও ফলাফলে সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি বলেই কি তদন্ত কমিশন গঠন? অথবা গ্রামীণ ব্যাংক কি বড় রকমের কোনো অঘটন ঘটিয়েছে, যার জন্য তদন্ত কমিশন বসাতে হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংক এমন কী জনগুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে তার ওপর তদন্ত চালাতে হবে?’
এই প্রশ্নগুলোর জবাব সংবাদপত্রে কিংবা টকশোতে আওয়ামী প্রতিহিংসার ভয়ে তেমন আলোচিত না হলেও ওয়াকিবহাল মহলে সবারই জানা, লোকমুখেও বহুল আলোচিত। লোকে বলে, অর্থমন্ত্রীর মনোনীত ‘অবিশ্বস্ত’ এক ব্যক্তিকে গ্রামীণ ব্যাংকের নয়া ব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ করতে ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ মালিকানাভোগী দরিদ্র সঞ্চয়ীরা একেবারেই নারাজ। তাদের বাগে আনতেই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে খুবই সফল অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি গ্রামীণ টেলিকম ইত্যাদির ওপরও লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আওয়ামী শেয়ারহাঙরদের। শেয়ারবাজার ডুবেছে, অর্থমন্ত্রী নিয়োজিত চাঁদাবাজ পরিচালকদের ঋণখেলাপি বন্দোবস্তের বদৌলতে সরকারি ব্যাংকগুলো আবার ডুবতে বসেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি ঋণের তাগিদ মেটাতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে, দুর্নীতির দায়ে বৈদেশিক সহায়তা প্রায় বন্ধ হয়ে টাকার দরপতন ডলার সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, এখন এসব অঘটনের ঘটক অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে দরিদ্রের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘গরিব মহিলাদের মালিকানা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বময় মতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে তার মূল ল্য থেকে সরিয়ে দেয়া। যেকোনো রকম ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে এ রকম একটা পদপে নেয়ার অর্থ হবে গ্রামীণ ব্যাংককে অন্য আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা। যে আইন, ব্যবস্থাপনা কাঠামো, কর্মপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হতে পেরেছে, সেই বিশ্বজয়ী ফর্মুলাকে অবশ্যই অপরিবর্তিত রাখতে হবে।’ কালের পরীায় গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপযোগিতা ও সাফল্যের ওই পরীতি যথার্থ ছাড়াও নাগরিক অধিকারসচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিমালিকানায় যে অলঙ্ঘনীয় অধিকার রায় প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক জাতিরাষ্ট্রের সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ, বর্তমানে মতাসীন সরকার ওই তদন্ত কমিশন গঠন করে দরিদ্র হলেও আত্মকর্মসংস্থানে সবল গ্রামীণ ব্যাংক সদস্যদের সমষ্টিগত সম্পত্তির নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মৌলিক অধিকারে অবৈধ হস্তপে করছে কি না। জনপ্রশাসনে অভিজ্ঞ মহলে আরো প্রশ্ন উঠেছে, কোনো অঘটন বা গুরুতর অভিযোগ ছাড়া নিছক ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ এমন সন্দেহের অজুহাতে ওই তদন্ত কমিশন নিয়োগ ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ আইন, ১৯৫৬-এর অপব্যবহার ও সীমালঙ্ঘন কি না। আর জনে জনে লোকমুখে ধিক্কার উঠেছে : ভূমিদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, শেয়ারহাঙরদের দোসর অর্থমন্ত্রী মুহিত এখন গরিব মানুষের ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা হাতড়াচ্ছে, নিপাত যাক এই অর্থমন্ত্রী, তার মুখ 
দেখতে চাই না, তার দেয়া বাজেটে মানুষের কোনো মঙ্গল হবে না। 
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট